জীবনে সফলতা কি
আমরা যখন আলোচনা করি 'কীভাবে আরো বেশি প্রোডাক্টিভ হওয়া যাবে, কীভাবে জীবনকে করে তোলা যাবে আরো অধিক অর্থবহ'— তখন অবধারিতভাবে আমরা কুরআন থেকে সূরা আল-আসরকে কোট করি এবং কী নির্মমভাবে যে জীবনে পাওয়া অন্যতম নিয়ামাহ 'সময়' এর ব্যাপারে আমরা ভয়াবহ রকম উদাসীন, তার আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করি।
এটা অবশ্যই ঠিক যে, নিয়ামত হিশেবে 'সময়' মানবজাতির হাতে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। 'জন্ম - বংশবিস্তার - মৃত্যু'— এই চক্রেই দুনিয়ার দুই তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়। এর মাঝে তাদের জীবনে থাকে কিছু বিনোদন, কিছু খেল-তামাশা আর কিছু দুঃখ-সুখের গল্প। একটা সার্থক এবং অর্থবহ জীবনের খোঁজ পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পায়।
'অর্থবহ' জীবন বলতে কী বুঝায় তা যদিও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, তবু ইসলামি জীবন পদ্ধতির আলোকে বললে বলতে হয় যে— একটা সার্থক, অর্থবহ জীবন মানে রবের সন্তুষ্টিলাভের দৌঁড়ে অন্য অনেকের চাইতে এগিয়ে থাকা।
জীবনের অর্থবহতাকে অনেকে ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন। তাদের মতে, অর্থবহ জীবন মানে একটা ঝকমকে ক্যারিয়ার। সেই ঝকমকে ক্যারিয়ারের অর্থবহ জীবনকে খুঁজতে গিয়ে আমরা নেমে পড়ি এক অনিঃশেষ প্রতিযোগিতায়। আমাদের সামনে উদাহরণ পেশ করা হয় বিল গেটস, জাকারবার্গ প্রমুখের। তারা তাদের সময়কে কীভাবে কাজে লাগান, তারা কতোখানি পরিশ্রমী, উদ্যমী এসব গল্প আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বোঝানো হয় যে— এদের জীবনটাই অর্থবহ জীবন। এদের মতো হও, তাহলেই সত্যিকার সফলতার খোঁজ মিলবে।
কিন্তু, অর্থবহ জীবনের এটা এক নিদারুন ভুল ব্যাখ্যা। একজন মানুষ জীবনে কী চায়, তা অর্জনের ওপরে নির্ভর করে তার জীবনের অর্থবহতা।
ধরা যাক, একজন স্কুল শিক্ষকের স্বপ্ন তিনি এমন দশটা ছাত্র তৈরি করবেন যারা দেশকে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতে। তারা হবে মেধাবি, নীতিবান, সৎ এবং যোগ্য। এই স্বপ্ন পূরণে ওই স্কুল শিক্ষক কতোখানি সফল তার ওপরে ভিত্তি করে তিনি বুঝতে পারেন যে তার জীবন কতোখানি অর্থবহ। যার স্বপ্ন দশটা মেধাবি, সৎ এবং যোগ্য মানুষ তৈরি করা, তাকে বিল গেটস কিংবা জাকারবার্গের গল্প শুনিয়ে লাভ কী?
আবার ধরা যাক, একজন লেখকের স্বপ্ন তিনি জীবনে এমন দুটো বই লিখবেন যা তাকে মৃত্যুর পরেও বাঁচিয়ে রাখবে। মানুষ তার বইগুলো পড়ে উপকৃত হবে, তাকে স্মরণ করবে, তার জন্যে দুয়া করবে। তার ধারণা— এই কাজ করা গেলেই তার জীবন অর্থবহ হয়ে উঠবে।
এখন, এমন দুটো বই লিখতে হলে তাকে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হবে, পড়াশুনা করতে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে, শ্রম দিতে হবে। সবগুলো শর্ত পূরণ করে যদি তিনি সেরকম দুটো বই লিখতে পারেন, তাহলে তিনি অন্তত নিজের কাছে একজন সার্থক মানুষ এবং তার কাছে তার জীবন অর্থবহ।
এই স্বপ্নবাজ মানুষটিকে আমার সেভাবেই স্বপ্ন দেখানো উচিত যেভাবে সে তার স্বপ্নকে সাজাতে চায়। তাকে ওয়ারেন বাফেট কিংবা বিল ক্লিনটন হওয়ার স্বপ্ন দেখালে সে হতাশাগ্রস্ত মানুষ ছাড়া জীবনে আর কিছুই হতে পারবে না।
সুতরাং, জীবনের অর্থবহতা নির্ধারিত হবে আপনার স্বপ্নকে ঘিরে। আপনি যদি মনে করেন যে, একটা মুদি দোকানের মালিক হওয়াই আপনার লালিত স্বপ্ন, তা অর্জনের জন্য চেষ্টায় লেগে পড়ুন। তা অর্জিত হওয়া মানে আপনার জীবন অর্থবহতার দৌঁড়ে একধাপ এগিয়ে গেলো। একজন সন্তানকে আলেম বানানো, কিংবা বিজ্ঞানী বানানো, অথবা একজন সৎ চিকিৎসক বানানো যদি আপনার স্বপ্ন হয়— তার পেছনে লেগে থাকুন। তা পূরণে দিনরাত কাজ করে যান। আপনার স্বপ্নের সীমানার মধ্যেই আপনার জীবনের অর্থবহতা লুকোনো, অন্যের স্বপ্নকে অন্ধ অনুকরণের মাঝে নয়।
আরিফ আজাদ
No comments: