কাবুল বিজয়
হিজরী প্রথম শতাব্দির মধ্যভাগ।
বসরা শাসন করছেন উমাইয়াদের নিযুক্ত গভর্নর যিয়াদ বিন আবি সুফিয়ান। নিজ নিয়ন্ত্রিত এলাকার দেখভালের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার দিকেও সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে তাকে। যিয়াদের আগের গভর্নর আবদুল্লাহ বিন আমের (রা) এর সময় থেকেই খোরাসান হয়ে উঠেছে বিদ্রোহীদের স্বর্গরাজ্য। তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে। বাধ্য হয়ে উমাইয়ারা খোরাসানকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকের জন্য পৃথক সেনাপতি নিয়োগ দিলেন। উত্তর আফগানিস্তানের বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব পেলেন কাইস বিন হাইছাম ও আবদুল্লাহ বিন হাযেম। এ সময় বলখে বসবাসকারী একটি অগ্নিপূজক সম্প্রদায় নিয়মিত বিশৃঙ্খলা করছিল। কাইস বিন হাইছাম এই বিদ্রোহীদের দমন করেন এবং তাদের অগ্নিকুন্ড ধ্বংস করে দেন। আবদুল্লাহ বিন হাযেম এগিয়ে যান হেরাতের দিকে। একের পর এক আক্রমনে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন বিদ্রোহীদের। (১)
মধ্য ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের দায়িত্ব ছিল বিখ্যাত সাহাবি আবদুর রহমান বিন সামুরাহ (রা) এর কাঁধে। হজরত উসমান (রা) এর শাসনামলে যখন এই অঞ্চল বিজিত হয়েছিল তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে। সে সময় চুক্তির মাধ্যমে কাবুল জয় হয়েছিল কিন্তু কিছুদিন পরেই কাবুল থেকে কান্দাহার পুরো এলাকা আবার মুসলমানদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। হজরত আবদুর রহমান বিন সামুরাহ (রা) সেনাবাহিনী নিয়ে কাবুলের দিকে অগ্রসর হলেন। উদ্দেশ্য, এই এলাকাকে আবারও ইসলামি শাসনের অধীনে আনা। তার এই বাহিনীতে বেশ কয়েকজন সাহাবি ও তাবেয়ী ছিলেন। যাদের মধ্যে মুহাল্লাব বিন আবি সুফরাহ, আব্বাদ বিন হুসাইন, হিশাম বিন আমের, হাসান বসরি ও কাতারি বিন ফুজাআ উল্লেখযোগ্য। (২)
সেনাবাহিনী এগিয়ে গেল কাবুলের দিকে। পথে সুউচ্চ পর্বতগুলো পাশ কাটানো হলো সতর্কতার সাথে। কোনো সদস্য যেন বাহিনী থেকে ছিটকে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা হল শক্তভাবে। সফরকালে সিলা বিন আশইয়ামের খচ্চর হারিয়ে গেল। তিনি দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ আপনি আমার খচ্চর ও জিনিসপত্র মিলিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরেই খচ্চরকে পাওয়া গেল জিনিসপত্রসহ। (৩)
কাবুলে যাওয়ার পথে একটা ঘটনা ঘটলো। সিলা বিন আশইরাম ও হিশাম বিন আমের বাহিনীর আগে আগে যাচ্ছিলেন। তাঁরা দুজনই তাবেয়ী। হিশাম বিন আমের ছিলেন হজরত আবু হুরাইরা (রা) এর খাস শাগরেদ। তারা যে এলাকা পার হচ্ছিলেন তা ছিল একটি জংলী উপজাতির দখলে। আচমকা তারা হামলা করে বসে। সিলা ও হিশাম দুজনে মিলে তীব্রভাবে তাঁদের প্রতিহত করেন। তাদের সাহসিকতা ও বীরত্ব দেখে উপজাতি যোদ্ধারা চমকে যায়। তারা অবাক হয়ে বলতে থাকে, মাত্র দুজন সেনা আমাদেরকে এ অবস্থা করে ফেললো। তাহলে পুরো বাহিনী এলে না জানি কী করে বসে। তারা তখনই মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে নেয়।
পরে হজরত আবু হুরাইরা (রা) এই যুদ্ধের কথা জেনেছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, হিশাম তো এই যুদ্ধে নিজেকে ধবংস করার সকল চেষ্টাই করেছিলেন। এই কথা শুনে আবু হুরাইরা (রা) রেগে যান। তিনি শক্ত কন্ঠে বলেন, কখনো নয়। সে তো নিজেকে এই আয়াতের লক্ষ্য বানাতে চাচ্ছিল যেখানে বলা হয়েছে,
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاء مَرْضَاتِ اللّهِ وَاللّهُ رَؤُوفٌ بِالْعِبَادِ
আর মানুষের মাঝে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদের জানের বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান। [ সুরা বাকারা ২:২০৭ ] (৪)
এভাবে সেনাবাহিনী কাবুলের উপকন্ঠে এসে উপস্থিত হলো। প্রাকৃতিকভাবেই কাবুল সুরক্ষিত একটি শহর। পাহাড়ের কারণে যে কোনো বাহিনীর আক্রমন দীর্ঘদিন আটকে দেয়ার মত সক্ষমতা এই শহরের ছিল। শহরের বাসিন্দারাও লড়াই কিংবা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল। ফলে এই শহর জয়ের কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। আবদুর রহমান বিন সামুরাহর বাহিনী শিবির স্থাপন করলো শহরের বাইরে। শহরটি অবরোধ করার নির্দেশ দিলেন তিনি। টানা কয়েক মাস মুসলমানরা এই শহর অবরোধ করে রাখে। ইতিমধ্যে শীতকাল এলে শুরু হলো তুষারপাত। শুভ্র তুষারে ছেয়ে গেলে গাছপালা, উপত্যকার পথগুলোও হয়ে উঠলো বিপদসংকুল। মরু জীবনে অভ্যস্ত আরবদের জন্য এই সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। পেঁজা তুলার মত উড়তে থাকা তুষার সেনাদের ছাউনিগুলোকে শুভ্র করে ফেলতো। যখন বাতাস বইতো, শীতের তীব্রতায় তা যেন হাড় ভেদ করতো। কিন্তু মুসলমানরা বিন্দুমাত্র মনোবল হারালেন না, পিছুও হটলেন না। তারা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে দৃঢ় রইলেন। এভাবে শীত পার হয়ে বসন্ত এলো। মুসলমানরা তখনো কাবুল অবরোধ করে রেখেছেন। এ সময় তারা কসর পড়ছিলেন, কারণ স্থায়ী অবস্থানের উদ্দেশ্য ছিল না। (৫)
যার যা কাজ, সে তা ছাড়তে পারে না। মুসলমানদের এই সেনাবাহিনীর অবস্থাও ছিল এমন। একদিকে চলছিল অবরোধ, ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছিল অপেক্ষার প্রহর, অপরদিকে সময়টা মুসলমানরা কাজে লাগায় ইলমচর্চায়। প্রায় দিন আবদুর রহমান বিন সামুরাহ (রা) হাদিস ও ফিকহের দরস দিতেন। তার সামনে বসে দরস শুনতেন হাসান বসরি, ইবনে হাবিব ও ইবনে উবাইদের মত বিখ্যাত তাবেয়িরা। (৬) তারা ছিলেন একইসাথে আলেম ও মুজাহিদ। ইলমকে তারা নিয়েছিলেন আমল করার প্রস্তুতি হিসেবে। জিহাদ তাদের কাছে শুধু কিতাবের পাতায় আটকে থাকা কোনো বিধান ছিল না, নিজেরা এই বিধান বাস্তবায়নে ছিলেন সচেষ্ট। ইলম অর্জনের ব্যস্ততা দেখিয়ে তারা জিহাদ ত্যাগ করেননি। আবার জিহাদের ময়দানে এসেও ইলম অর্জনে গাফলতি করেননি। এভাবেই তারা ইলম ও জিহাদের মাঝে করে নিয়েছিলেন সমন্বয়, দুটিকে মুখোমুখি দাঁড় করাননি।
বসন্তের শুরুতে কাবুলের বাগানগুলো নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠলো। গাছে গাছে গজালো নতুন পাতা। শুভ্র তুষারের চাদর সরিয়ে ঝলমল করে হেসে উঠলো পাহাড়গুলো। শীতে জমে যাওয়া বরফ গলে পানি আবারও সচল হলো। নদীর কলকল ধ্বনি আবারও ফিরে এলো। মুসলমানরা প্রস্তুত হলো আরো একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য।
-
আবদুর রহমান বিন সামুরাহ সিদ্ধান্ত নিলেন মিনজানিক ব্যবহার করবেন। পরের কয়েকদিন মিনজানিক থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপ করা হলো কাবুল শহরের নিরাপত্তা প্রাচীর লক্ষ্য করে। পাথরের আঘাতে প্রাচীরের গায়ে বড় একটি ফাটল ধরে যায়। শহরবাসী সিদ্ধান্ত নেয় রাতেরবেলা এই ফাটল মেরামত করে ফেলবে। কিন্তু আব্বাদ বিন হুসাইনের নেতৃত্বে তীরন্দাযরা সারারাত সেই স্থান লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে শহরবাসীর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই লড়াইয়ে আব্বাদ বিন হুসাইন অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। পরে তার সম্পর্কে হাসান বসরি রহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন, আব্বাদ বিন হুসাইনকে দেখার আগে আমি কল্পনাও করতে পারিনি কখনো কখনো একা একজন মানুষ হাজার মানুষের সমান হয়ে যায়। (৭)
শহরবাসী বুঝতে পারলো কাবুলের পতন আসন্ন। মরিয়া হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, শেষবারের মত আক্রমন করা হবে মুসলমানদের উপর। একদিন ভোরে শহরের ফটল খুলে যায়। ধেয়ে আসে যোদ্ধারা। তাদের সাথে ছিল একটি যোদ্ধা হাতি। প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত এই হাতি যে কোনো সেনাবাহিনীর জন্যই ছিল আতংকের অপর নাম। হাতি বের হতে দেখেই আবদুল্লাহ বিন খাযেম এগিয়ে গেলেন হাতির দিকে। তরবারির আঘাতে হাতিটিকে তিনি হত্যা করেন। হাতিটি ফটকের গায়ে এমনভাবে ঢলে পড়ে যে ফটক লাগানোর পথও বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে মুসলমানরা শহর প্রবেশ করে। অল্পসময় পরেই মুসলমানদের হাতে জয় হয় কাবুল। শহরের প্রাচীরে উড়তে থাকে মুসলমানদের পতাকা।
-
কাবুল জয়ের ফলে মুসলমানদের হাতে প্রচুর গনিমত আসে। শুরুর দিকে কেউ কেউ গনিমতের মাল সরানোর চেষ্টা করছিল। আবদুর রহমান বিন সামুরাহ ঘোষণা দেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা লুটপাট করে তারা আমাদের কেউ নয়। সুতরাং যে যা নিয়েছ তা ফিরিয়ে দাও। এই ঘোষণার পর সবাই লুটকৃত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। আবদুর রহমান বিন সামুরাহ সমানভাবে সেনাদের মধ্যে তা বন্টন করে দেন। (৮)
শহর জয়ের পর বন্দীদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশেষ করে দাস ও শিশুদের পড়াশোনা শেখানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এই দাস ও শিশুদের মধ্যে অনেকে ছিল মেধাবী। তারা ইসলাম গ্রহন করে আলেমদের দরসে বসে নিজেরাও ইলমের মহান মর্যাদা অর্জন করেন। সালেম বিন আজলান, আবু আইয়ুব সাখতিয়ানি প্রমুখ এই যুদ্ধে বন্দী হন। পড়ে তারা বড় আলেম হয়েছিলেন। (৯)
টীকা
১। ফুতুহুল বুলদান, ৩৯৬ – বালাযুরি
২। প্রাগুক্ত, ৩৮৪
৩। কিতাবুয যুহদ, ৮৬৩ – আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক
৪। শুয়াবুল ঈমান , বর্ননা নং ২৯৪১ – বাইহাকি। কিতাবুয যুহদ, ৮৬৩ – নুয়াইম বিন হাম্মাদ।
৫। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, ৫০৯৯ /৮০২৩
৬। আস সুনানুল কুবরা, বর্ননা নং ৬০০৮, ৬০৪৫ – বাইহাকি
৭। মাকারিমুল আখলাক, ১/৬৫- ইবনু আবিদ দুনিয়া
৮। মুসনাদে আহমাদ, বর্ননা নং ২০৬১৯ – ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল
৯। তারিখে খলিফা বিন খইয়াত, ২০৬ – খলিফা বিন খইয়াত
(মাওলানা ইসমাইল রেহানের লেখা অবলম্বনে)
No comments: