ads

কুরবানি ও প্রথা

বাড়িতে খুব কম আসা হয় কয়েক বছর যাবত, যার দরুন বাড়ির চাচাতো জেঠাতো ভাইদের সাথে দেখা সাক্ষাতও হয় একেবারে কদাচিৎ। ঈদ-কুরবানে এলেই যা একটু দেখা হয়। এবার বাড়িতে এসে দেখি তাদের অনেকেই অনুপস্থিত। চাকরিস্থলে, কিংবা শহরের বাসা, যেখানে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে, সেখানেই থাকছে, বাড়ি আসছেনা। একজনকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি রে, বাড়ি আসবি না?'

- 'যাবো, তবে কুরবানির পরের দিন'।
- 'কেনো? ছুটি হয় নাই?'
- 'ছুটি তো হয়েছে, কিন্তু কুরবানি দিতে পারছি না, তাই লজ্জা লাগছে ঈদের দিন ঘরে থাকতে।'
খারাপই লাগলো। ঈদুল আযহার যে মূল স্পিরিট সেটা হলো তাকওয়া। আল্লাহকে ভয় করা, ভালোবাসা, আল্লাহর জন্যে ত্যাগ করতে পারা। পশু কুরবানি দেওয়াটা বিশাল এই স্পিরিটের একটা অংশ কেবল, সবটাই নয়। কিন্তু আমরা, বাঙালি মুসলমানেরা ঈদুল আযহাকে 'ইমেজের ঈদ' বানিয়ে ফেলেছি। পশু কুরবানি দেওয়া না গেলে, দিতে না পারলে, সামর্থ্যে না কুলোলে আমাদের ইমেজে তা বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমার চাচাতো ভাইয়ের মতোন এমন অসংখ্য মুসলমান পাওয়া যাবে আমাদের চারপাশে যারা কেবল পশু কুরবানি দিতে না পারার লজ্জায় ঈদের সালাত পড়তেও কুন্ঠাবোধ করবে, ঈদগাহেও আসবে না।
দোষটা আমার চাচাতো ভাই কিংবা যারা এই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে- তাদের নয়। দোষটা আমাদের শিক্ষা এবং সিস্টেমের। যে লোক পশু কুরবানি দিতে পারেনি বা পারে না, তার কি তাকওয়া অর্জন করতে নিষেধ? যে লোকের সামর্থ্য নেই গরু কেনার, তার জন্যে কি জিলহজের প্রথম দশ দিনের আমল-ইবাদাত, আরাফাহর দিনের সিয়াম পালন, যাবতীয় নফল ইবাদাত করতে মানা? জিলহজের শিক্ষা অনেক, তাকওয়া অর্জনের উপায়ও অঢেল এই মাসে, কিন্তু এখানে কেবল হাইলাইট করা হয় পশু কুরবানিকে, এবং এটাকেই বানানো হয়েছে ইমেজ রক্ষা আর স্ট্যাটাস প্রমাণের মাপকাঠি।
এই সিস্টেমের কুফল অনেক গভীরে প্রোথিত। এই সিস্টেম প্রসিদ্ধি পেয়ে যাওয়াতে জিলহজ মাসের অনেক শিক্ষা বিলুপ্তির পথে আজ। যারা কেবল প্র্যাকটিসিং মুসলিম- তারাই পশু কুরবানির বাইরের অন্যান্য আমল-ইবাদাতের খোঁজখবর রাখে, বাকিরা এসবের ব্যাপারে একেবারে ওয়কিবহাল নয়। এই সিস্টেম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ফলে সমাজে যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তা হলো- শ্রেণী-বিভাজন। ছোটবেলা থেকেই আমরা ঠাহর করতে শিখেছি- যারা কুরবানি দেয় বা দিতে পারে, তারা হচ্ছে বড়লোক, আর যারা দিতে পারে না তারা গরীব। এই শ্রেণী-বিভাজনের ফলে একটা বিভেদ-রেখা, একটা অস্পষ্ট বড় আর ছোট'র দেওয়াল সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
নিজের স্ট্যাটাস প্রমাণের জন্যে, কিংবা সমাজের চোখে নিজেকে বড় করে দেখানোর তাগিদে পশু কুরবানি করার একটা রীতিও আজকাল সু-প্রসিদ্ধ আমাদের সমাজে। আমি আমার চারপাশে এমন লোককেও দেখি যারা ঋণ করে, কিস্তি থেকে টাকা উঠিয়ে কিংবা ধার-দেনা করে হলেও পশু কুরবানি দেয়। কারণ- যদি কুরবানি না দিতে পারে তার নাম চলে যাবে সমাজের গরীবদের তালিকায়। এলাকায়, মহল্লায়, বাড়ির ঘরে ঘরে কানাঘুষা চলবে- 'হায়! ওদের তো দিনকাল খারাপ যাচ্ছে! দেখছো না কুরবানি দিতে পারছে না এ বছর'।
পরের চোখে গরীব প্রমাণ হওয়াতে আমাদের ভীষণ ভয়। এই ভয় থেকে বাঁচতে সুদের টাকায় গরু কিনে কুরবানি করে, সেই সুদ সারাবছর টানতে আমাদের আপত্তি নেই। অথচ, কি পবিত্র একটা ধর্মীয় বিধানকে সুদের মতোন জঘন্য, অপবিত্র সিস্টেমের কবলে ফেলে আমরা নিজেদের ইমেজ রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। এই যে সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার কুফল, এসব থেকে বেরিয়ে আসা না গেলে আমরা দিন দিন বক-ধার্মিক হয়ে উঠবো।
ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানিতে টইটম্বুর তাকওয়া ছিলো, আমাদের কুরবানিগুলোতে টইটম্বুর ইমেজ রক্ষার তাগিদ ছাড়া অন্যকিছু থাকছে কি?
.
আরিফ আজাদ

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.