ads

সামাজিক মাধ্যমের ভয়াবহতা

 কয়েকদিন আগে একটা মেইল আসলো আমার কাছে। যিনি মেইল লিখেছেন তিনি একজন তেইশ বছরের যুবক আর যার ব্যাপারে লিখেছেন তিনি পঞ্চাশোর্ধ একজন বৃদ্ধ— তার পিতা।

একেবারে ভগ্নপ্রায় হৃদয়ে জানালেন—ফিতনার এই কঠিন সময়ে, নফসের সাথে যুদ্ধ করে তিনি নিজের নজরের হেফাযত করবার আপ্রাণ চেষ্টায় নিয়োজিত; কিন্তু সাম্প্রতিক একটা ঘটনা তার হৃদয়কে একেবারে ভেঙে খান খান করে দিয়ে গেলো। সেটা হলো— তার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের পিতার ফোন ঘাঁটতে গিয়ে কোন এক লুকোনো ফোল্ডারে আবিষ্কার করেছেন একগাদা অশ্লীল ভিডিও। জীবনের অন্তিমলগ্নে বৃদ্ধ বাবার এমন পদস্খলন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না সদ্য যৌবনে পা রাখা সংযত চরিত্রের এই যুবক।
কিছুদিন আগে বাড়িতে গেলে আমার এক স্কুলবন্ধুর সাথে দেখা। সে আগের মতোই আছে দেখলাম— নিতান্ত হাবাগোবা এবং পড়াশোনার মতো জীবনের ঘানি বইতেও নিদারুন অপটু। কথা বলতে বলতে ফেইসবুক প্রসঙ্গ উঠে এলো। ফেইসবুকে একটা জিনিস সে খুঁজে পায় না কোনোভাবেই। আমি বললাম, 'আরেহ! খুব-ই তো সহজ! দাও, খুঁজে দিই'।
তার ফেইসবুক আইডির সার্চবারে ক্লিক করে আমি মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম যেন! আমার দুধভাত চেহারার বন্ধুটা ফেইসবুকে কি-সব খুঁজে বেড়ায়, কি দেখে সময় কাটায় তার একটা আমলনামা আমার সামনে টলটলে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো।
কেনো পঞ্চাশোর্ধ বয়সের একজন বৃদ্ধের ফোনের গোপন ফোল্ডারে পাওয়া যাবে অশ্লীল ভিডিও? কেনো ভরপুর যৌবনের অধিকারী কিন্তু নিতান্তই অবোধ-বৈশিষ্ট্যের এক যুবক ফেইসবুকে অশ্লীল জিনিস ঘেঁটে বেড়ায়? কারণ— প্রযুক্তির নির্মম সহজলভ্যতা!
'সহজলভ্য' শব্দটার সাথে 'নির্মম' শব্দের ব্যবহার বেশ অসহজলভ্য হলেও, আমার মতে— যে জিনিসের সহজপ্রাপ্তি একটা সমাজকাঠামোকে, একটা সভ্যতাকে অধঃপতনের দুয়ারে ঠেলে দেয়, তাকে নির্মম না বলে আর উপায় থাকে না।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার দিনে আমরা গুনে গুনে এর সহস্র, অজুত, নিযুত, কোটি ভালো দিক বর্ণনা করতে পারবো, সেই তুলনায় এর মন্দ-দিক হয়তো একেবারে হাতেগোনা। কিন্তু সেই হাতেগোনা কয়েকটা মন্দ-দিকের শক্তি এতোই প্রবল আর প্রচন্ড যে— একটা সমাজকে ভেঙেচুরে দিতে, একটা সভ্যতাকে লন্ডভন্ড করে দিতে তা একদম যথেষ্ট!
প্রযুক্তি বলতে আমি এখানে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্মার্টফোনের দিকটাই বিবেচনা করছি মূলত যা মানুষের দ্বারে দ্বারে, হাতে হাতে নয়, মিশে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায়। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, এই শতাব্দীর সেরা কয়েকজন টেক-সুপারস্টার, যারা বিশ্ব-প্রযুক্তিতে যুক্ত করেছে নানান মণি-মুক্তো, সেই সুপারস্টাররাও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই টেকনোলোজির দুনিয়া থেকে যথাসম্ভব দূরেই রাখতে চান।
স্টিব জবস, যিনি আইফোন কোম্পানির সিইও ছিলেন মৃত্যুর আগ-অবধি, তিনি তার সন্তানকে তার-ই উদ্ভাবিত আইপ্যাড ব্যবহার করতে দিতেন না।
মাইক্রোসফটের একসময়কার সিইও বিল গেটসের ঘরে বাচ্চাদের স্মার্ট-ফোন ব্যবহার, স্ক্রীনের সামনে থাকবার সময়টুকু বেশ সীমাবদ্ধ। পুরোদিনে একঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টার মতো তার বাচ্চারা স্ক্রীন তথা মোবাইল অথবা কম্পিউটারের সামনে কাটাতে পারতো।
একই ঘটনা স্ন্যাপচ্যাটের মালিকের বেলাতেও।
এই যে বড় বড় টেক-জায়ান্টরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে টেকনোলোজি তুলে দিতে এতো সংকীর্ণ— তা কেনো বলুন তো? টেকনোলোজির এতো চমৎকার গুণ কিংবা নিযুত-কোটি ভালো দিক আমার আপনার চাইতে তারা তো অনেকগুণ বেশি জানে এবং বুঝে। তবুও কেনো তারা চায় না যে তাদের বাচ্চারা টেকনোলোজির যথেচ্ছ ব্যবহার করুক? কারণ, টেকনোলোজির যে ক্ষতির দিকটা আছে, তা যে কতো ভয়ঙ্কর এবং বিভীষিকাময়— তা আমি এবং আপনি না বুঝলেও তারা ঠিকই বুঝে। তারা জানে এর যথেচ্ছ ব্যবহার দিনশেষে কি পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
পরিণতি হলো— আমরা বৃদ্ধ বাবার ফোনে অশ্লীল ভিডিও আবিষ্কার করবো, দুনিয়াকে খুব বেশি না বোঝা বন্ধুটাকেও ভার্চুয়াল অন্ধকার গলির নিয়মিত খদ্দের হতে দেখবো। এবং এভাবেই সমাজে ছড়িয়ে পড়বে এক মর্মান্তিক বিশৃঙ্খলা।
যে লোক অশ্লীল ভিডিওতে নিজের চোখ ডুবিয়ে রাখে, তার সামনে দিয়ে খোলামেলা মহিলাই যাক, কিংবা পর্দা-হিজাবে আবৃত কেউ— সে কিন্তু এসবের কোনোটাই চিন্তা করবে না। সে চিন্তা করবে একদলা মাংশপিন্ড হেঁটে যাচ্ছে তার চোখের সামনে দিয়ে যে হয়তো দেখতে অমুক ভিডিওতে দেখা ওই মেয়েটার মতোই। হয়তো-বা....
ধর্ষক রাতারাতি তৈরি হয় না, ধর্ষক তৈরির অনেকগুলো নিয়ামক আছে। সেই অনেকগুলো নিয়ামকের একটা হলো— নৈতিকতার অবক্ষয়। সেই কাজটা খুব ভালো করে করে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া আর হাতে হাতে থাকা স্মার্টফোন।
ধর্ষকের শাস্তির জন্য আমরা তৎপর হচ্ছি, আন্দোলন করছি, চারদিক থেকে অসংখ্য মানুষ তাতে জড়ো হচ্ছে, সাঁয় দিচ্ছে, সমর্থন করছে যা বিরাট আশার ব্যাপার সমাজের জন্য। কিন্তু যে নিয়ামকগুলো আস্তে আস্তে একজন মানুষকে ধর্ষক হতে প্রণোদনা দেয়, যে উপকরণগুলো একজন মানুষের নৈতিক পদস্খলন ঘটায় যা তাকে বানিয়ে তুলে পটেনশিয়াল রেপিস্ট, সেগুলোর ব্যাপারেও তৎপর হবার এখনই সময়।
প্রযুক্তির এই যথেচ্ছ ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ঘরে ঘরে হাজারো দেলোয়ার সুপ্তাবস্থায় থাকবে। কেবল সুযোগ এবং ক্ষমতার অভাবে তারা তাদের বাসনা চরিতার্থ করতে পারবে না। পেলে...
ঠিক করা দরকার, প্রযুক্তির ব্যবহার আমি কিরূপ করছি? আমার ভাই, আমার বাবা, আমার বোন? আমরা কেউ দেলোয়ার তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে নেই তো?

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.