সালাতুল আওয়াবিন কোন নামায
কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আওয়াবিনের নামায কোনটি তাহলে উত্তর আসবে মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী নামায। বিষয়টি এতোটাই প্রসিদ্ধ যে অন্য কোন নামাযের নাম 'সালাতুল আওয়াবিন' হতে পারে, এটি কারো কল্পনায়ও আসে না। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
আমরা এসম্পর্কে আজ একটু বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাঅাল্লাহ।
সহিহ এবং নির্ভরযোগ্য হাদিসে চাশতের নামাযকেই আওয়াবিনের নামায বলা হয়েছে।
এসম্পর্কে কয়েকটি হাদিস দেখুন:
ক.
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন- ‘‘আমাকে আমার বন্ধু [রাসুল সা.] প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা, ঘুমানোর পূর্বে বিতরের নামায পড়া এবং চাশতের নামায পড়ার ওসিয়ত করেছেন, কেননা এটি [চাশতের নামায] হচ্ছে, আওয়াবিনের নামায। -মুসনাদে আহমদ: 16/329; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ: 2/227
খ.
হযরত কাসিম আশ-শাইবানি রহ. বলেন, হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. একদল লোককে (সূর্য উদিত হওয়ার পরপর) চাশতের নামায পড়তে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, তারা কি জানে না যে চাশতের নামায অন্য সময়ে উত্তম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
صَلَاةُ الأَوَّابِينَ حِينَ تَرْمَضُ الْفِصَالُ
‘‘আওয়াবিনের নামাযের সময় হচ্ছে, যখন সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত বালুর কারণে উটের বাচ্ছার পা উত্তপ্ত হতে থাকে।’’-সহিহ মুসলিম, হাদিস ৪৬৬
'রামায' শব্দের অর্থ হচ্ছে, সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত বালু। আর فصال শব্দটি আরবি فصيل এর বহুবচন। এর অর্থ উটের ছোট বাচ্ছা। এবার হাদিসের অর্থ দেখুন। ‘‘আওয়াবিনের নামায হচ্ছে, যখন সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত বালুর কারণে উটের বাচ্ছার পা উত্তপ্ত হতে থাকে। ’’
কথাটি সহজে এভাবে বলা যায়- ‘‘আওয়াবিনের নামাযের সময় হচ্ছে, যখন সূর্যের উত্তাপ খুব বেশি হয়। ’’
যায়েদ ইবনে আরকাম রা. এর উপরিউক্ত বর্ণনায় দু’টি বিষয় পাওয়া গেল: এক. সালাতুদ্দুহা তথা চাশতের নামায হচ্ছে, সালাতুল আওয়াবিন। দুই. চাশতের নামায যদিও সূর্য উদিহ হওয়ার পর থেকেই পড়া যায়; তথাপি চাশতের নামাযের উত্তম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সূর্যের উত্তাপ খুব বেশি হয়।
গ.
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত অপর হাদিসে এসেছে- ‘‘ আওয়াব’ তথা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী ব্যক্তিই চাশতের নামাযের প্রতি যত্নশীল। আর এই নামায হচ্ছে, সালাতুল আওয়াবিন।-সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ১২২৪
প্রশ্ন হলো, চাশতের নামযকে কেন সালাতুল আওয়াবিন বলা হয়?
কারণ, আওয়াব শব্দের অর্থ আল্লাহর দিকে বেশি বেশি প্রত্যাবর্তনকারী। আর যে ব্যক্তি সর্বদা চাশতের নামায পড়ে সে তো আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারীই হবে।
উপরিউক্ত হাদিসগুলোর কারণে কেউ কেউ মনে করেন, শুধু চাশতের নামাযের নামই সালাতুল আওয়াবিন; এছাড়া অন্য কোন নামাযকে সালাতুল আওয়াবিন বলাই যাবে না। বিশেষত মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী নামাযকে আওয়াবিন বলার কোন ভিত্তি নেই।
শায়খুইল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. তাঁর ‘সালাসিলে তাইয়্যিবাহ’ গ্রন্থে চাশতের নামায সম্পর্কে বলেন, এটাই আওয়াবিনের নামায; কিন্তু সাধারণ মানুষ ভুলবশত মাগরিবের পরের নামাজকে আওয়াবিনের নামাজ বলে থাকে।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যদিও সহিহ হাদিসে চাশতের নামাযকে আওয়াবিনের নামায বলা হয়েছে, কিন্তু মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী নামাযকে 'সালাতুল আওয়াবিন' বলা একেবারে ভিত্তিহীন এবং অমূলক নয়। বরং বিভিন্ন রেওয়ায়েতে এ নামাযকেও আওয়াবিনের নামায বলা হয়েছে। যেমন:
ক.
মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির রহ. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময়ে নামায পড়বে তার এই নামায আওয়াবিনের নামায -অায যুগদ, ইবনুল মুবারক রহ. হাদিস ৯৯৮; মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, মারওয়যী, পৃ. ৮৮ [হাদিসটি মুরসাল, তবে এর সনদ সহিহ]
খ.
হযরত আমর ইবনু আস রা. বলেন-
صَلاةُ الأوَّابِينَ الْخَلْوَةُ الَّتِي بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ، حَتَّى يَثُوبَ النَّاسُ إِلَى الصَّلاةِ
আওয়াবিনের সময় হচ্ছে, মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময় যাতে মানুষ নামাযের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
-আয যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদিস 999; ফাজলু কিয়ামিল লাইল, আজুরি, হাদিস 41 [হাদিসটি মওকুফ, সনদে মুসা ইবনে উবাইদা রাবি দুর্বল তবে ইমাম তিরমিযি রাহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, হিফজ তথা স্মরণ শক্তির ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে দুর্বলতা থাকলেও তিনি সাদুক রাবি]
গ.
আতা ইবনে আব রাবাহ রহ.বলেন, মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময় গাফলতের সময়। আর এটিই হচ্ছে, আওয়াবিনের নামাযের সময়-হিলইয়াতুল আওলিয়া: 5/200
মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী নামাযকে কেন আওয়াবিন বলা হয়?
ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, আওয়াব শব্দের অর্থ আল্লাহর দিকে বেশি বেশি প্রত্যাবর্তনকারী। আর যে ব্যক্তি সর্বদা মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী নামায পড়বে সে তো আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারীই হবে। তাছাড়া আওয়াব অর্থ অধিক তাওবাকারী। আর যে ব্যক্তি রাতের বেলা এই নামায পড়ল, সে যেন দিনের কর্মের উপর তওবা করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করল। এজন্য এই নামাযকে আওয়াবিন বলা হয়।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে একথা পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে, সহিহ হাদিসে যদিও চাশতের নামাযকে আওয়াবিনের নামায বলা হয়েছে তথাপি মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী নামযকে আওয়াবিন বলা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। বরং এটাকেও হাদিসে আওয়াবিনের নামায বলা হয়েছে।
শুধু মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী নামায কেন এ ছাড়াও তো আরো কিছু নামাযকে হাদিসে সালাতুল আওয়াবিন নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন:
এক.
ঘরে প্রবেশ এবং ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দু’রাকাত নামায:
এসম্পর্কে উসমান ইবনে আবি সাওদাহ রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সালাতুল আওয়াবিন অথবা বলেছেন, সালাতুল আবরার হচ্ছে, দু’রাকাত যখন তোমার ঘরে প্রবেশ করবে আর দু’রাকাত যখন ঘর থেকে বের হবে।
–আয যুহদ, ইবনুল মুবারক, 1011 [হাদিসটি মুরসাল, তাবে এর সনদ সহিহ]
দুই.
ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত আদায় করা এবং ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করা:
এসম্পর্কে উরওয়া ইবনে রুয়াইম হ. বলেন: যে ব্যক্তি ফজরের দু’রাকাত [সুন্নাত] আদায় করবে এবং ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করবে, তাঁর নামাযটি আওয়াবিনের সালাতের মধ্যে লেখা হবে। -মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: 3/58 [হাদিসটি মুরসাল, তাবে এর সনদ নির্ভরযোগ্য]
তিন.
মাগরিবের আযান এবং ইকামতের মধ্যবর্তী নামায:
এসম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আওয়াবিনের নামায হচ্ছে, মাগরিবের আযান এবং ইকামতের মধ্যবর্তী নামায।-মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, পৃ. 73 [তিনি সনদ উল্লেখ করেন নি।
No comments: