ads

ইয়ারমুক

 প্রকাশিতব্য ছোট্ট "ইয়ারমুক" বইটি থেকে দুয়েকটা তথ্য শেয়ার করি। রোমান ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্বাপর ও ধারাবাহিকতা বুঝতে এই অংশটুকু যুক্ত করা হয়েছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে যে-ক’টি পরাশক্তি ও ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্য শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার কারণে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, রোম সাম্রাজ্য তার অন্যতম। প্রবল ক্ষমতার পাশাপাশি রোম সাম্রাজ্যের সেনাপতিরা দিগ্বিদিক বিজয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত সবসময়। ফলতঃ ক্ষমতার পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর একটিও এই রোম সাম্রাজ্য। হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের মুসলিম ভূগোলবিদ ইয়াকুত হামাভি লেখেন, “রোম সাম্রাজ্যের পরিধি ছিল পুব ও উত্তরে তুরস্ক, কাস্পিয়ান সাগর ও রাশিয়া পর্যন্ত, দক্ষিণে শাম ও আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত এবং পশ্চিমে সাগর ও স্পেন পর্যন্ত। কিসরাদের সময়েও রাক্কা এবং পুরো শাম অঞ্চলকে রোমের পরিধির অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হতো। সম্রাটের নিবাস থাকত আন্তাকিয়াতে।”[মু’জামুল বুলদান ৩/১১১, ইয়াকুত হামাভি]
রোম সাম্রাজ্য মোট চৌদ্দটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত ছিল বলে জানা যায়। যার তিনটির অবস্থান ভূমধ্যসাগরের ওপারে এবং বাকিগুলো এপারে।
১. কনস্টান্টিনোপল। কনস্টান্টিনোপলের সীমানা পূর্বদিকে কাস্পিয়ান সাগর থেকে লেভান্টাইন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত উপসাগর, কিবলার দিকে লেভান্টাইন সাগর এবং পশ্চিম দিকে লেভান্টাইন সাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সুবিশাল নগর প্রাচীর।
২. থ্রেস (Thrace)। কনস্টান্টিনোপলের ঠিক পিছনে অবস্থিত এই প্রদেশটির সীমানা পূর্ব দিকে সেই সুদীর্ঘ প্রাচীর, কিবলার দিকে মেসিডোনিয়া প্রদেশ এবং পশ্চিম দিকে পনেরো দিনের দূরত্বে বুরজান নগর। এর মধ্যখানে অবস্থিত থ্রেস প্রদেশ।
৩. মেসিডোনিয়া। সুদীর্ঘ সেই প্রাচীরটির অবস্থান মেসিডোনিয়ার পূর্ব সীমানায়, কিবলার দিকে লেভান্টাইন সাগর আর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সাকালিবা (Saqaliba)। এই নিয়ে মেসিডোনিয়া। কনস্টান্টিনোপল, থ্রেস ও মেসিডোনিয়া প্রদেশ তিনটি ভূমধ্যসাগরের ওপারে অবস্থিত। এর বাইরে বাকি এগারোটি প্রদেশ ভূমধ্যসাগরের এপারে অবস্থিত।[মু’জামুল বুলদান ৩/১১১-১১৩, ইয়াকুত হামাভি; আল-মাসালিক ওয়াল মামালিক, পৃষ্ঠা-১০৫-১০৭, ইবনে খুরদায বেহ]
আরবি ভূগোলের গ্রন্থাবলিতে এই প্রদেশগুলোর বিবরণ পাওয়া গেলেও অধিকাংশেরই সঠিক উচ্চারণ ও বর্তমান নাম খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। হিজরি তৃতীয়-চতুর্থ শতকের মুসলিম ভূগোলবিদ আবু মুহাম্মাদ আল-হামদানি নিজেও রোমের এইসব শহরের নাম নিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। প্রদেশগুলোর বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “রোম সাম্রাজ্যের শহরগুলোর বিবরণের ক্ষেত্রে এমন কিছু নাম আছে, যেগুলো আমি তাহকিক করে সঠিক উচ্চারণ খুঁজে পেতে সক্ষম হইনি। সুতরাং পাঠক যেন এই ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করেন।”[মু’জামুল বুলদান ৩/১১১, ইয়াকুত হামাভি] এটি চতুর্থ শতকের শুরুর কথা।
এই নামগুলো বর্তমানে কেন পাওয়া যায় না—এর উত্তর দিয়েছেন ইয়াকুত হামাভি রহ.। হামদানির সূত্রে সবগুলো প্রদেশের বিবরণ বিস্তারিত উল্লেখ করার পর বলেন, “আমার যা ধারণা, এই নামগুলো মূলত প্রাচীনকালের। আমার মনে হয় না এখনো এইসব নাম পাওয়া যাবে। যুগের পরিবর্তনে সেসব শহরের নাম বদলেছে, পাল্টেছে স্থাপনাগুলোর নাম। এর প্রমাণ হলো, আজ আমরা খ্রিষ্টান বা মুসলিমদের হাতে রোমের অধিকৃত যেসব প্রসিদ্ধ শহর দেখতে পাই, সেগুলোর বিশেষ উল্লেখ তখন পাওয়া যায় না। আবু মুহাম্মাদ হামদানি যেভাবে উল্লেখ করেছেন, আমি কেবল সেভাবে উল্লেখ করে গেলাম।”[মু’জামুল বুলদান ৩/১১৩, ইয়াকুত হামাভি]
ইয়াকুত হামাভি হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের মানুষ। ৫৭৪-৬২৬ হিজরি তাঁর জীবনকাল। পাঁচ-সাত কিংবা হাজার বছর পূর্বের রোম সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোর নাম স্বভাবতই পাল্টেছে। যার দরুন চতুর্থ শতকের হামদানির যুগে এসেই বহু নামের উচ্চারণ বিস্মৃত হয়ে গেছে। সপ্তম শতকে এসে বহু নাম যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে ইয়াকুত হামাভি সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তারও সাড়ে আটশো বছর পর এসে যে অল্পকিছু প্রসিদ্ধ নাম ছাড়া বিস্তারিত শহরগুলোর নাম পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তা জানা কথা। তাই আবু মুহাম্মাদ হামদানির বিবরণ দেখে অধিকাংশ নামই বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে যদি কোনো ওরিয়েন্টালিস্ট বা খ্রিষ্টান গবেষক সময় ব্যয় করে অনুসন্ধান করেন, তাহলে ইতিহাসের প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহরের নাম-বিবরণ জানা যাবে। তবে তা একজন মুসলিম গবেষক সময় ব্যয় করার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
রোম টু বাইজান্টাইন
রোমকদের আদি-অন্ত ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে এক বিশাল ফিরিস্তি ফাঁদা যাবে। তবে প্রেক্ষাপট বুঝতে আপাতত আমাদের এর বেশি প্রয়োজন নেই। রোম থেকে বাইজান্টাইন কীভাবে হলো—এবার সেদিকে ফেরা যাক।
৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট যখন বসফরাসের তীরবর্তী প্রাচীন বাইজান্টাইন নগরী বিজয় করেন, কার্যত তখনই বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়।[আল-মুসলিমুনা ওয়ার রুম ফি আসরিন নুবুওয়াহ, পৃষ্ঠা-১৭, আব্দুর রহমান আহমাদ সালেম] কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট ভগ্নপ্রায় বাইজান্টাইন নগরী পুনঃনির্মাণ করে নিজের নামে নামকরণ করেন। বাইজান্টাইন হয়ে যায় কনস্টান্টিনোপল। ভোগৌলিকভাবে সুবিশাল রোম সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। বাইজান্টাইন ছিল পূর্ব রোমের অন্তর্গত। পুনঃনির্মাণের পর সম্রাট কনস্টান্টিন বাইজান্টাইন বা কনস্টান্টিনোপলকে পূর্ব রোমের রাজধানী ঘোষণা করেন।
রোমান গবেষক নরম্যান বেনেস বলেন, “মোটকথা হলো, রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মীয়, সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও সামরিক—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তিত হয়ে বাইজান্টাইন কেন্দ্রিক হয়ে যায়।”[আল-ইমবারাতুরিয়্যাতুল বিযানতিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৭] ভোগৌলিকভাবে বাইজান্টাইন নগরী ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত শহরগুলোর একটি। একে আরও সুরক্ষিত করতে কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট শহররক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেন।[আল-ইমবারাতুরিয়্যাতুল বিযানতিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৮, নরম্যান বেঞ্জ] এটি ছিল নতুন রোমের সূচনা।
৪০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোম ও বাইজান্টাইন মিলে ছিল অখণ্ড রোম সাম্রাজ্য। সম্রাট থিউডোসিয়াস মৃত্যুর সময় আনুষ্ঠানিকভাবে রোম সাম্রাজ্যকে পূর্ব ও পশ্চিম দুইভাগে ভাগ করে দুই পুত্র আর্কেডিয়াস(Arcadius) এবং অনারিয়াসকে (Honorius) দিয়ে যান। আর্কেডিয়াসের ভাগে পড়ে পূর্ব রোম আর অনারিয়াসের ভাগে পড়ে পশ্চিম রোম। আর্কেডিয়াসের সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য।[আল-মুসলিমুনা ওয়ার রুম ফি আসরিন নুবুওয়াহ, পৃষ্ঠা-২০, আব্দুর রহমান আহমাদ সালেম] এখান থেকেই বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সূচনা হয়।
অবিভক্ত রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রাচীন নগরী রোম। পশ্চিম রোমের রাজধানী ছিল মিলানে, যার পূর্বনাম মেডিয়োলেনুম (Mediolanum)। ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তা রেভেনাতে(Revenna) স্থানান্তর করা হয়। পূর্ব রোমের রাজধানী ইতিপূর্বে মেসিডোনিয়াতে থাকলেও কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট তা বাইজান্টাইন নগরীতে স্থানান্তর করেন।
সম্রাট থিউডোসিয়াস যখন দুই পুত্রের মাঝে রোম সাম্রাজ্যকে ভাগ করে দেন, রোমানরা তখন পার্শ্ববর্তী নানা জাতির হুমকির মুখে। এই সময় রোমান সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে ওঠে জার্মান গথ (Goths) ও মোঙ্গল হান(Hun) জাতি। এই দুই জাতি একের পর এক রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাতে থাকে। বহিঃশক্তির মোকাবেলায় থিউডোসিয়াসের এই সিদ্ধান্ত ছিল সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার উত্তম পদক্ষেপ। কিন্তু এর একশো বছর পার হওয়ার আগেই জার্মান গথ জাতির হাতে রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী রোমের পতন ঘটে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে সময়টা তখন ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ।[আল-মুসলিমুনা ওয়ার রুম ফি আসরিন নুবুওয়াহ, পৃষ্ঠা-২০, আব্দুর রহমান আহমাদ সালেম]
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর টিকে থাকে কেবল পূর্ব রোমান বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য। কনস্টান্টিনোপলকে ঘিরে পরিচালিত হওয়া এই সাম্রাজ্যটি দীর্ঘকাল পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে—বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলতে আমরা যে-সাম্রাজ্যকে চিনি, তা মূলত রোমান সাম্রাজ্যের অর্ধেক অংশ। অপর অংশের পতন ঘটায় শক্তিমত্তা নিয়ে টিকে থাকে কেবল এই অংশটি। ফলতঃ পরবর্তী যুগে রোমান সাম্রাজ্য বলতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.