ads

কানামাছি

 রোকেয়া পড়ে আছে টেবিলে। রোকেয়া রচনাবলী। আজ রোকেয়া দিবস। শফিক তার প্রিয় লেখিকাকে আজ স্মরণ করবে তার লেখা কিছু পড়ে। সে সাধারণত এমনটিই করে। স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার গান, পহেলা বৈশাখে "এসো হে বৈশাখ" আর ঈদের দিনে "ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে"। মানে যেদিন যে দিবস তার মর্যাদা তো একটু রাখা দরকার!

শুরুতেই "আমাদের অবনতি" প্রবন্ধ। শফিক পড়ে যাচ্ছে- "কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ... আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ইশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। ... এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাঁহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। ... ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।"
এই ক্ষণে শফিক বইটা রাখলো। শফিকের অনেক প্রিয় কিছু লেখিকা আছেন যারা আদতে নারীবাদী। সেক্ষেত্রে সে বেগম রোকেয়াকে ধার্মিক নারীবাদী হিসেবেই দেখতো। কিন্তু তার লেখার এ অংশটুকু তাকে ভাবাচ্ছে। এদিকে অফিসের সময় হয়ে গেছে। তার স্ত্রী শিউলি নাস্তার জন্য ডাকছে।
"আচ্ছা, জানু! তুমি আমাকে আজ থেকে "অর্ধাঙ্গ" বলবে। "স্বামী" শব্দটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলন।" রুটি ছিড়তে ছিড়তে শফিক বললো।
তার স্ত্রী পানির গ্লাস হাত থেকে রেখ বললো, "এটা তো খুব কঠিন। আমি পারবো না।"
"দেখো, শিউলি! তুমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়ে বলে এখনো আধুনিক চিন্তা গ্রো করেনি। আমি যেখানে তোমার ভালো চাইছি, তাও তুমি বোঝো না? ব্যাকডেইটেড মেয়ে!"
"আচ্ছা! ঠিকাছে, অর্ধাঙ্গ! গো করো না।"
"জানো, আজকাল ফেইসবুকে জোরেশোরে কথা হচ্ছে নারী পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে "কনসেন্ট" আর "বৈবাহিক ধর্ষণ" নিয়ে। উন্নত দেশগুলোতে এ বিষয়ে আইন আছে। অথচ দেখো, অশিক্ষিতদের এ দেশে এগুলোর বিষয়ে কথাই বলা যায় না। হাজার হাজার মিসোজিনিস্ট তোমার কথার উত্তর দেওয়ার জন্য রেডি।"
"আচ্ছা, কনসেন্ট মানে তো সম্মতি। তুমি কি বলতে চাচ্ছো, বিয়ে না করেও কেবল সম্মত হলেই শারিরীক সম্পর্ক করা যাবে?"
"উন্নত দেশে তো তাই করে। আসলে আমি কিছু প্রথিতযশা লেখিকার বই পড়ে দেখলাম, বিয়ে না করেও মানুষ সুখী হতে পারে যদি তাদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকে। আর তা না থাকলে বিয়ে করে কী হবে?"
"কিন্তু ব্যাপারটা তো গুনাহ! হারাম! ব্যভিচার। Don’t you think of it?” শিউলির রাগ হলো। তার স্বামী এসব কী বলছে? তার সন্দেহ হলো হয়তো শফিক অফিসের কোনো কলিগ বা অন্য কোথাও পরকীয়ায় লিপ্ত। তা সামনে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, আর বৈবাহিক ধর্ষণের ব্যাপারে?"
"মানে ধরো তুমি চাচ্ছো না, এমতাবস্থায় আমি যদি তোমাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করি, তবে তা অপরাধ।"
"হুম! বিবাহ বহির্ভূত হলে অপরাধ!"
"বিবাহবহির্ভূত!" শফিক কথাটা রেগে গিয়ে জোরে উচ্চারণ করলো "আচ্ছা, বিবাহবহির্ভূত হলেই সম্মতি থাকলেও অপরাধ! আর বিয়ের আওতায় সম্মতি না থাকলেও বৈধ! দেখো, এসব আমি মানি না। আমি মনে করি, যতক্ষণ না আমি কারও ক্ষতি না করি, আর তার সম্মতি থাকলে আমি যাচ্ছে তাই করতে পারি। এতে তৃতীয় কারও বাপের কী?"
"হোয়াট অ্যাবাউট তোমার স্ত্রী! তোমার সংসার! তাদের বিশ্বাস ও আস্থা!"
"দেখো, এতে করে আমি তো তোমার ক্ষতি করছি না। যখন তোমার দরকার তুমি আমায় পেলেই হলো। আচ্ছা, আমি এখন উঠি। অফিসে লেইট হয়ে যাচ্ছে" বলেই শফিক হাত ধুয়ে নিলো। শিউলির মাথাটা ধরে এলো।
অনেক দিন পর। শিউলি রান্নাঘরে। যদিও আজকাল রান্না করাটা তার ভালো লাগে না খুব। সে এখন আফসোস করে ক্যারিয়ারটা কেন হারিয়েছে তা নিয়ে।
ওদিকে শফিক অফিস থেকে ফিরে তার ফোন খুঁজে পাচ্ছে না। অফিসে বোধ হয় ফোন রেখে চলে এসেছে। আচ্ছা, শিউলির ফোনটা থেকে একটা কল করলে কেমন হয়? শফিক শিউলির কাছ থেকে তার ফোন নিয়ে কল করে দেখলো কল হচ্ছে, কেউ ধরছে না। লাঞ্চ করার সময় ড্রয়ারে রেখে এসেছে।
ফোনটা রাখতে যাবে, এমন সময় "Ki koro?” এমন একটা মেসেজ দেখতে পায় শফিক। বাবু নামের এক প্রোফাইল থেকে আসা। সে ক্লিক করে দেখে আরও কিছু কনভার্সেশন আছে এই আইডির সাথে। শফিকের মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!
শফিক দরজাটা লাগিয়ে এলো। এসে দেখে বেশ অন্তরঙ্গ কথাবার্তা এ আইডি ও শিউলির আইডির সাথে। অর্ধাঙ্গ হিসেবে তার মনে হচ্ছে শিউলি তার সাথে বেইমানি করেছে। আচ্ছা, না হয় বিয়ে একটা সামাজিক ফালতু সিস্টেম। কিন্তু সে কী শিউলিকে ভালোবাসেনি? ভালোবাসার কী কোনো মানে নেই?
না না! তাকে শক্ত হতে হবে। তার স্ত্রীরও তো স্বাধীনতা আছে। শুধু শুধু মেইল শোভিনিস্টদের মতো চিন্তা করছে সে। তার চেয়ে ভালো হয় আগে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলা। না বলে তাকে দোষ দেওয়ার মতো মিসোজিনিস্ট সে না।
"আচ্ছা, তুমি যখন চাও, বাবুর সাথে তুমি চলে যেতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।"
"কে বাবু? কীসের বাবু?"
"ওমা! আকাশ থেকে পড়লে! এসব কী?" বলে মেসেঞ্জারের মেসেজ সে দেখালো। "তোমার কী একটুও আমার কথা মনে হয়নি?"
"মনে তো হয়েছে। কিন্তু আমার ও তার মাঝে কনসেন্ট আছে। তোমার কোনো সমস্যা?"
শফিক মহাচিন্তায় পড়ে গেল। থিউরিগুলো তখন মনের উপর যেমন আটা দিয়ে লাগিয়ে নিয়েছিল সে এখন আর আলগা করতে পারছে না। কিন্তু শফিক চেষ্টা করছে।
"আমার অনেক সমস্যা! তুমি ইদানীং বেশি নারীবাদী হয়ে গেছো?"
"দেখো, তুমি পারলে আমি পারবো না কেন?"
"আমি পারলে মানে? আমি কী করলাম? আমি কী কারও সাথে কিছু করেছি? আর করলেও তোমার ক্ষতি কী? আমি তো কনসেন্ট নিয়েই করেছি। আমি তো তোমাকে বৈবাহিক... " শফিক দেখলো সেও শিউলির মতো একই যুক্তি দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে।

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.