অবরোধের গুরুত্ব
মুসলিমদের বয়কট করার মানসিকতা বদলে দিয়েছিলো ইউরোপের ভাগ্য!
১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপল জয় করেন মুসলিম তুর্কি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ। খ্রিস্টানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং রোমান সম্রাজ্যের উত্তরসূরি বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের পতন ইউরোপকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। বসফরাস প্রণালী মুসলিমদের অধীনে চলে যাওয়ার ফলে প্রাচ্যের সাথে বানিজ্যের জন্য ইউরোপকে এখন হয় উসমানী তুর্কি অথবা মামলুকদের উপরে নির্ভর করতে হবে। ইউরোপের ন্যাভাল সুপারপাওয়ার ভেনিস ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই মামলুক সালতানাতের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মামলুকদের সাথে বানিজ্যের সুবাদে ভেনিস প্রাচ্যের মশলা, রেশমের ব্যবসায় ইউরোপে একচেটিয়া আধিপত্য লাভ করে। ইউরোপের অন্য শক্তিগুলোর সামনে তখন দুটো রাস্তা খোলা ছিলো।
১. মুসলিমদের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা।
২. তাদের বয়কট করা।
প্রথম রাস্তায় হাঁটলে নিজেদের লাভের বিনিময়ে মুসলিমরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হয়ে যেতো। ইউরোপের বানিজ্যের উপর মুসলিমদের প্রভাব বেড়ে যেতো বহুগুণ। মুসলিমরা ইউরোপের রাজনীতির খেলায় আরো বেশি প্রভাবশালী হয়ে যেতো। যেকোনো দেশের উপর অবরোধ চাপিয়ে তাদের কোনঠাসা করার মতো প্রভাবশালী হয়ে যেতো মুসলিম শক্তিগুলো, যেমনটা একসময় ব্রিটিশরা করতো আর এখন আমেরিকানরা।
ইউরোপ দ্বিতীয় রাস্তাটাতেই পা বাড়ালো। স্পেন ও পর্তুগাল ছিলো প্রাচ্যের অল্টারনেটিভ সমুদ্রপথ আবিষ্কারে সবচেয়ে আগ্রহী। আইবেরিয়ার শেষ মুসলিম আমিরাত গ্রানাডা জয়ের পর আইবেরীয় খ্রিস্টানশক্তি নিজেদের ক্রুসেডীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো শুরু করে ভিন্নভাবে। সিল্ক রোডের বিকল্প হিসেবে সমুদ্রপথে ভারত পৌঁছানো, মুসলিমদের বানিজ্যিক সুবিধা না দেয়া এবং খ্রিস্টধর্ম প্রসার ছিলো আইবেরীয় খ্রিস্টানদের প্রধান উদ্দেশ্য। ইউরোপের অন্যতম ন্যাভাল পাওয়ার জেনোয়া স্প্যানিশদের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে। স্পেনের ক্রাউনের পক্ষ থেকে জেনোয়িস নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস একদিকে আমেরিকা মহাদেশের, অন্যদিকে পর্তুগীজ ক্রাউনের পক্ষ থেকে ভাস্কো দ্য-গামা ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে। স্পেন ও পর্তুগালের হাত ধরেই এজ অফ এক্সপ্লোরেশন এবং কলোনিয়াল আমলের সূচনা। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ এবং ডাচরা দ্রুতই স্পেনের দেখাদেখি নিউ ওয়ার্ল্ডে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়। যার ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সবচেয়ে শক্তিশালী কলোনিয়াল সম্রাজ্য হিসেবে এমার্জ করে, আমেরিকার জন্ম হয় এবং আফ্রিকা ও এশিয়াকে ইউরোপ কয়েকশো বছর শোষণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজেদের ইচ্ছামাফিক সীমানানির্ধারণ করে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোর জন্ম দেয়।
অন্যদিকে একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরের বানিজ্য ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। ভেনিস এবং উসমানী সম্রাজ্য আগের গুরুত্ব হারায়। নিয়মিত বানিজ্যের ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তির আদানপ্রদানও ঘটে। উসমানী সালতানাতের পিছিয়ে পড়ার বড় কারণগুলোর একটি ছিলো ভূমধ্যসাগরীয় বানিজ্যের গুরুত্ব কমে যাওয়া এবং ইউরোপীয় শক্তির কাছে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য হারানো। যেখানে ইউরোপের শক্তিগুলো কলোনিগুলো শোষণ করে ইউরোপকে উন্নত করেছিলো।
.
অবরোধ কোনো হাসিতামাশার বিষয় না। কাউকে যুদ্ধে পরাজিত করার মতো শক্তি না থাকলে অবরোধ কোনো কাপুরুষতাও নয়। বরং, নিজেদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার দ্বারা একদিকে নিজেদের শক্তি বাড়ে, শত্রুর উপর নির্ভরতা কমে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্নভাবে। রাশিয়ার সাথে নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনার অভাবে যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানোর কৌশল অবলম্বন করে আসছে এখন পর্যন্ত।
তাই অবরোধকে ছোটো করে দেখা, হাসিতামাশা করা লোকেরা হয় আদৌ এর উপকারীতা সম্পর্কে অবগত নয়, অথবা তারা পশ্চিমের চিন্তাদাস যারা পশ্চিমের সাদা প্রভুদের গোলামী ত্যাগ করার কথা চিন্তা করতে অক্ষম।
Azher Mahmud
No comments: