দেয়ালের আর্তনাদ
আইওয়া’র লুথারিয়ান কলেজে আসলাম আজকে। উদ্দেশ্য প্রফেসর টড গ্রিনের সাথে দেখা করা। গতকাল আচমকা তার সাথে দেখা। শিকাগোতে একটা মেডিকেল কনফারেনসে গিয়েছিলাম। বের হয়ে আসার পথে চোখে পড়লো। পরিচয় দিলাম, বললাম আপনার বই পড়েছি। পরে আলাপ হলো বেশ কিছুক্ষণ। ভদ্রলোক অফিসে আসার দাওয়াত দিলেন। পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে উবার ডেকে চলে এলাম। খুঁজে বের করলাম কলেজে তার রুম।
নক নক
- মি. টড, আসবো?
- আরে! ডা. রাফান, কাম ইন। তা কেমন আছেন আপনি?
- ভালো আছি। আপনি?
- এই তো, আই অ্যাম গুড। তা আলাপ শোনার লোভ সামলাতে পারেন নি দেখছি, টোপ গিললেন তাহলে!
- হা হা, জ্ঞানের টোপ স্যার, না গিলে থাকা যায়?
- হুইস্কি চলে? ব্ল্যাক ভেলভেট আছে!
- নো মি. টড, থ্যাংকস।
- গুড মুসলিম, হা?
- গুড অর ব্যাড, হু নোওজ।
- হা হা, ইউ আর ইন্টারেস্টিং মি. রাফান।
- মে বি অর নট। এনিওয়ে, গতকালের আলাপ মিউজিয়ামে গিয়ে থেমেছিল।
- হ্যা, ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার হামলার স্মরণে বানানো মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম উন্মোচনের এক মাস পরেই। আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। মন আর শরীর যেন সেই ৯/১১’র স্মৃতির সাথে জুড়ে যাচ্ছিল। প্রায় ২৭০০ জন মানুষ প্রাণ হারায় সেদিন।
- কতক্ষণ ছিলেন?
- ছিলাম অনেকক্ষণ। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আসার সময় মন ভার হয়ে ছিল। সেদিনের দুঃখ, দুর্দশা আর স্বজনহারাদের স্মৃতি মনে করে। কিন্তু..
- কিন্তু?
- কিছুক্ষণ পরে একটা বিষয় খেয়াল হলো। মানে হঠাৎই বলা যায়। মিউজিয়ামের আয়োজন দেখে আমার আবেগ অল্পকিছু মানুষের দুর্দশার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, কিন্তু ভুলিয়ে দিয়েছিলো আরো অনেককে!
- মানে?
- দেখুন ডাক্তার, একটু বড় পরিসরে চিন্তা করুন। ওয়ার অন টেরর-এর নাম করে ইরাক আর আফগানিস্তানে যে পরিমান নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার তুলনায় ৯/১১’র হত্যাকাণ্ড কিছুই না। কিন্তু এই নিরীহ, বেসামরিক মানুষগুলোর দুর্দশার স্মৃতি ৯/১১-স্মৃতি জাদুঘর-এ নেই।
- হুম।
- আরো ভেবে দেখুন, ৯/১১ হামলার দোহাই দিয়ে যেসব গ্রেফতারকৃত মানুষ ও যুদ্ধবন্দীদের উপর আমেরিকার মদদে নিপীড়ন চালানো হয়েছে তাদের স্মৃতিও আমরা বেমালুম ভুলে আছি। তাদের উপর ঘটা অত্যাচার, সিআইএ’র নিষিদ্ধ এলাকার কথা আপনি স্মৃতি জাদুঘরে পাবেন না। পাবেন না অগণিত মানুষের আর্তনাদের হদিশ—যারা ধর্ষিত হয়েছে, বলাৎকারের শিকার হয়েছে, ওয়াটারবোর্ডিং-এর মত অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মনে হচ্ছিল, আমাদের যেন তাদের কান্না-আর্তনাদ নিয়ে ভাবনায় বাধা দিতেই এই আয়োজন করা হয়েছে! এই মিউজিয়ামে তাদের কোনো স্মৃতি তো নেই-ই , আমার জানামতে আর কোনো মিউজিয়াম নেই যেখানে ওয়ার অন টেরর-এ বলি হওয়া অজস্র নিরীহ মানুষের কান্নার কথা আছে।
তিনি থামলেন। প্রফেসর টডের গলা ভারি হয়ে আসে।
- আর ইউ ওকে মি. টড?
- হ্যা, মি. রাফান। আসলে কি জানেন, আমেরিকার ইতিহাসে একটা বিষয় বেশ কমন। আমেরিকার হাতে যারা অন্যায়ভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে তাদের স্মৃতি আমরা আমেরিকানরা মুছে ফেলি। মনে রাখতে দিই না, ভুলিয়ে দিই।
প্রফেসর টড উদাস নয়নে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। কলেজের ক্যাম্পাসে ফুল ফুটে আছে। আকাশে পেজা তুলোর মত মেঘ।
কত মনে মেঘ জমে, কিন্তু বৃষ্টি হয় না।
বৃষ্টি তারা ভুলে গেছে।
No comments: