সেকুল্যারিজম
সংজ্ঞাগতভাবে সেক্যুলারিজমের দ্বিতীয় দিক হলো সকল মতের প্রতি উদার ও নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেকে ভালো-মন্দ নির্ধারণ করার যেই মাপকাঠি গ্রহণ করবে, তা মেনে নেওয়া। অন্যভাবে বললে, টলারেন্স- এর উদ্দেশ্য হলো, ভিন্নমতকে শুধু মেনে নেওয়াই নয়; বরং ভালো-মন্দের ধারণাগুলোর ভিন্নতাকে গুরুত্বহীন এবং অনর্থক মনে করা।
স্বাধীনতা, সমতা ও উন্নতিকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করার দাবি হলো, কেউ নিজের কল্যাণের ধারণার ভিত্তিতে অন্যকারো সমালোচনা করার কিংবা পরিবর্তন করার অধিকার রাখে না। এমনকি একজন পিতা তার সন্তানকেও নামাজ পড়ার জন্য জোরজবরদস্তি করতে পারবে না। জীবনপরিচালনার প্রতিটি পদ্ধতি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমানভাবে মেনে নেওয়ার নাম টলারেন্স। যখন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত খায়েশ পূরণ এবং জীবনপরিচালনার সমস্ত পদ্ধতি ও ধারণা সমান মর্যাদার, তখন প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক হলো অন্যের খায়েশ ও প্রবৃত্তি মেনে নেওয়া এবং তাকে সম্মান করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে টলারেন্সের নীতি গ্রহণ করার অর্থ হলো- ইসলাম ঘোষিত ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ প্রত্যাখ্যান করা। কারণ যখন ভালো-মন্দ নির্ধারণ করাকে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা হিসেবে মেনে নেওয়া হবে এবং কল্যাণের সমস্ত ধারণা সমান চোখে দেখা হবে, তখন মন্দের অস্তিত্ব অস্বীকার করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে। যে যার মতো করে ভালো-মন্দের সংজ্ঞা বানিয়ে নেবে আর সবাইকে অপরের এই ধারণার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এই অবস্থাতে পৃথিবীতে মন্দ বলে কিছু থাকছে না। ফলে নাহি আনিল মুনকারের প্রশ্নই আসছে না।
এই অবস্থাতে যদি ইসলামের নির্দিষ্ট কল্যাণের ধারণার ভিত্তিতে আমাদের কাছে কোনো মন্দাচার ধরা পড়ে, তা হলে তা মেনে নিতে হবে। তাকে প্রতিহত করার কোনো চিন্তাভাবনা এবং চেষ্টাপ্রচেষ্টা চালানো যাবে না। পশ্চিমা আকিদার দাবি হলো, অন্যের প্রতিটি কাজ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। মোটকথা, টলারেন্সের দৃষ্টিভঙ্গি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ‘নাহি আনিল মুনকার’ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতা, সমতা ও উন্নতিকে পৃথক মূলনীতি হিসেবে মেনে নেওয়ার অর্থ হলো, ইসলামও কল্যাণের সমস্ত ধারণা এবং মাপকাঠিকে সমান মনে করে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ কোনো জীবনব্যবস্থা নয় এবং ইসলাম একমাত্র কল্যাণ নয়; বরং ইসলাম একটি ব্যাপক জীবনব্যবস্থার অংশমাত্র, যেখানে কল্যাণের সমস্ত ধারণা ও মাপকাঠি সমান আর সেই ব্যবস্থার নাম হলো লিবারেলিজম।
এমন দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়। কারণ, দুনিয়ার সকল মত ও পথের জন্য শান্তিপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিত করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয় (সেক্যুলারিজমেরও না)। ইসলাম শুধু কিছু বিশ্বাস এবং নৈতিকতার নাম নয় যে প্রতিটি জীবনব্যবস্থার সাথে ইসলামকে মেলানো যাবে; বরং ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার মাঝে আকিদা ও নৈতিকতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অবস্থা বা কাজের বিধান রয়েছে। ইসলাম কখনোই অনেকগুলো কল্যাণের ধারণার মধ্য থেকে একটির দাবি করে না। বরং ইসলাম নিজেকে একমাত্র সত্য ও কল্যাণ হিসেবে ঘোষণা করে।
সুতরাং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে টলারেন্স এবং plurality (বহুত্ববাদ) এর কথা বলাই একটি অনর্থক বিষয়। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তি হক ও বাতিল চিহ্নিত হওয়ার পর এই দুটো বিষয়কে সমমর্যাদা ও অধিকার দিতে পারে না। উভয়টির জন্য সমান পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না। এটা মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে। ইসলাম tolerance এবং plurality of goods এর নীতিকে ধারণ করে- এমন দাবি হাস্যকর। যখন ইসলাম দাবি করছে ইসলামই একমাত্র হক এবং মুক্তি ও সফলতার অদ্বিতীয় পথ; অন্যান্য সব জাহান্নাম ও ধ্বংসের রাস্তা তখন ইসলাম ছাড়া সব বাতিল শক্তি প্রতিপালন করা এবং লাগামহীনভাবে ছেড়ে দিয়ে তাদের উন্নতির সর্বপ্রকার সহজ ব্যবস্থা করে দেওয়া মূলত ইসলামের উক্ত দাবির বিরোধিতা করা।
যদি কেউ বাস্তবেই ইসলামকে একমাত্র সত্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তা হলে তাকে এটাও মানতে হবে যে, ইসলাম পৃথিবীতে নিজস্ব জীবনব্যবস্থার বাইরে অন্যান্য জীবনব্যবস্থাকে পরাজিত করবে। একটি জীবনব্যবস্থাকে বাতিল মানা হবে আবার তার বিজয়কে বরদাশত করা হবে- এটা হাস্যকর ব্যাপার। একজন নির্বোধ মানুষই এমনটা মনে করতে পারে। কোনো জিনিসকে মন্দ হিসেবে চিহ্নিত করার পর পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাকে বিস্তার করার অধিকার দেওয়া আত্মঘাতী ও বোকামি সিদ্ধান্ত ছাড়া কী হতে পারে?
ইসলামের নিজেকে একমাত্র সত্য হিসেবে ঘোষণা করা এবং সর্বশক্তি-যোগে এর প্রতি আহ্বান করার আবশ্যকতা হলো, ইসলাম অন্য সব ব্যবস্থাকে মিটিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানাবে এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তার অনুসারীদের জানমাল উৎসর্গ করার নির্দেশ দেবে। কাফেররা আমাদের এই প্রচেষ্টা সহ্য করবে কি না এবং অমুসলিমদের সাহায্য আমরা পাব কি না- এখানে এসব প্রশ্নের কোনো তাৎপর্য নেই।
ইসলামের এমন মৌলিক অবস্থার স্বাভাবিক ফল হলো, প্রকৃত মুসলিমের অস্তিত্বই কুফুরি রাজত্বের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে। কারণ, কেউ মেনে নিক বা না নিক, সর্বাবস্থায় নিজের অনুসারীদের প্রতি ইসলামের দাবি হলো, যেখানে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত নেই, সেখানে সে তার হাকিমিয়্যাত প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করবে।
No comments: