নীড়ে ফেরা পাখি ও আমাদের উদাসীনতা
ব্রিটেনে নওমুসলিম বোনদের নিয়ে একটা রিপোর্ট পড়েছিলাম। সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছিল। এরমধ্যে একটি গুরুতর অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগটি হল, অন্যান্য সমস্ত মিশনারীদের কাছে তাদের নতুন সদস্যদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা ছিল। এদের আশ্রয়, দেখাশোনা করার নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মুসলিম কমিউনিটিতে সেটা ছিল না। নতুন দ্বীনে প্রবেশ করা ভাইবোনদের প্রথম কয়েকদিন গুরুত্ব থাকলেও কিছুদিন পার হলে তারা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেত।
ফলে এসমস্ত ভাইবোনেরা অনেক একাকীত্বে ভোগেন। এবং মানসিক ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন পেরেশানিতে কিংবা দ্বীন সম্পর্কে নিজের জ্ঞানকে পোক্ত করতে সহায়তার শূন্যতা অনুভব করতেন। যার দরুণ একসময় নিজ উদ্যোগেই ইলমের পথে অগ্রসর হতে হয় তাদের। কেউ কেউ আবার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন চাপ ও বাঁধার কারণে মারাত্মক ডিপ্রেশনেও ভুগতে থাকেন। অথচ এই সময়টাতে তাদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক কাউন্সিলিং সবচেয়ে বেশি জরুরী ছিল।
আমরা পরিপূর্ণ এক জাহেলী সমাজে বসবাস করছি। যেখানে অধিকাংশ সদস্যই বংশগত মুসলিম, চিন্তাগতভাবে নয়। আমাদের সমাজের অবস্থা অনেকটা নবীযুগের সাহাবাদের মত হতে যাচ্ছে। তখনকার সময় কেউ পৌত্তলিকতার ধর্ম ত্যাগ করে দ্বীনে ইসলামে প্রবেশ করলে তার উপর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নানা চাপ ও বাঁধা নেমে আসত। অনেকে তো পরিবার ও আত্মীয়দের হাতেই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হত। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে দ্বীনবিরোধী নানা প্রচারণার কারণে জনমনে দ্বীন পালন নিয়ে যেই ভীতি ও বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটা আমাদেরকে নবীযুগের সেই পরিস্থিতিতেই এনে দাঁড় করাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে জাহেলী জীবন ছেড়ে দ্বীনি জীবনে ফিরে আসা, আরো স্পষ্ট করে বললে বংশ ও প্রথাগত মুসলিম থেকে ইলমান ও চিন্তাগত মুসলিম হওয়াটা সেরকমই হয়ে গেছে। কোন ভাই কিংবা বোন যদি জাহেলী জীবন ছেড়ে দ্বীন প্রাক্টিস করা আরম্ভ করেন, তবে তিনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাঁধার শিকার হচ্ছেন। তাকে বিভিন্ন ট্যাগে জর্জরিত করা হচ্ছে। পরিবারের মত আপন লোকগুলোও তাকে হেনস্থা করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে যাচ্ছে।
একটা বাস্তবতা হল, ভাইদের চেয়ে বোনদের দ্বীনে ফেরার হারটা একটু বেশি। এটি আনন্দদায়ক। কারণ কোন কওমের মা জাতি যদি বিশুদ্ধ হতে থাকে, তবে সেই কওম আগামী প্রজন্মের ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারে। কিন্তু আরেকটি দুঃখজনক বাস্তবতা হল, দ্বীনে ফেরার পর তারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়ছেন। ছেলেদের ক্ষেত্রে সমস্যার হার খুব কম এবং অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের এই সমস্যাগুলো ফেইস করার সক্ষমতা থাকে। কিন্তু বোনদের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা চলে আসে।
একটা মেয়ে ইচ্ছা করলেই পরিবার থেকে দূরে থাকতে পারে না। আবার পারিবারিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কারো সংসারেও স্থান পেতে পারে না। ইনবক্সে এমন এমন ঘটনা আসছে যে, সেগুলো পড়ার পর চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন উত্তর প্রদান সম্ভব না। তার বোরকা পড়া নিয়ে কটু কথা শুনতে হচ্ছে, গাইরে মাহরামদের সামনে না আসা নিয়ে খোটা শুনতে হচ্ছে, সুদখোর ও দ্বীনহীন পাত্র রিজেক্ট করার জন্য মানসিক (এমনকি শারিরিক) টর্চারের শিকার হতে হচ্ছে।
যাইহোক সমস্যাটা সামগ্রিক। ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই, তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি। এই ক্ষেত্রে দ্বীনে ফেরা ভাইবোনদের জন্যও হিকমার সাথে করণীয় কিছু ব্যাপার আছে। কিন্তু সবার আগে দায়টা আমাদেরই। কারণ আমরা যেমন তাদেরকে কাউন্সিলিং করার জন্য কোন নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে সহজলভ্য করতে পারিনি, তেমন তাদের করণীয় বিষয়গুলোও তাদের কাছে সরবরাহ করতে পারিনি। ফলে আমি মনে করি, ইমাম, খতিব ও ইসলামি দলগুলো সহ সব ঘরণার দায়ীদের জন্য এই দিকটা নিয়ে ভাবা জরুরী। নতুন দ্বীনে ফেরা ভাইবোনদের নিরাপত্তা ও কাউন্সিলিং নিশ্চিত করা বর্তমান সময়ে দাওয়াতের অপরিহার্য দাবি।
No comments: