কাজি আবু বকর বাকাল্লানি
৩৭১ হিজরী।
ইযদুদ্দৌলার পক্ষ থেকে রোম সফর করেন একজন আলেম। এই সফরে রোমান সম্রাটের সাথে তার কিছু বিষয় আলাপ করার কথা ছিল। প্রথম দিন সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে আলেম দেখলেন দরবারে প্রবেশের দরজাটি খুব নিচু। ভেতরে প্রবেশ করতে হলে মাথা নিচু করে ঢুকতে হবে। আলেম বুঝে ফেললেন পুরো ব্যাপারটি পরিকল্পিত। রোমানদের নিয়ম হচ্ছে, সম্রাটের সামনে যেতে হলে কুর্নিশ করতে হয়। একজন মুসলমান হিসেবে আলেম এই কাজ করবেন না জানা কথা, ফলে তারা এমন ব্যবস্থা করেছে যেন তিনি বাধ্য হয়ে মাথা নিচু করেন। মুহুর্তের মধ্যে আলেম সমাধান খুঁজে নিলেন। তিনি নিজের মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন এবং দরবারের দিকে পিঠ দিয়ে উল্টোভাবে হেটে দরবারে প্রবেশ করেন।
দরবারে সম্রাটের সভাসদরা ছাড়াও খ্রিস্টান পাদ্রিরা উপস্থিত ছিলেন। পরিচয়পর্বের সময় এই আলেম এক পাদ্রীকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?’
পাদ্রী বিব্রত হয়ে চুপ থাকেন।
‘কাজী সাহেব আপনি সম্ভবত জানেন না, আমাদের পাদ্রীরা বিবাহ করেন না। তারা এসকল পার্থিব বিষয় থেকে পবিত্র’ সম্রাট বললেন।
‘বাহ চমৎকার, পাদ্রীরা স্ত্রী, ছেলে সন্তান থেকে পবিত্র। আবার আপনারাই আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করে দিচ্ছেন’ আলেমের উপস্থিত জবাব শুনে সম্রাট হতবাক হয়ে যান।
—
‘আপনাদের নবীর কথা বলুন। তিনি কি জীবদ্দশায় কোনো যুদ্ধ করেছেন?’ সম্রাট বললেন।
‘হা। তিনি অনেক যুদ্ধ করেছেন’ আলেম জবাব দিলেন।
‘এসকল যুদ্ধের ফলাফল কী? কে জিতেছে?’
‘কখনো আমাদের নবী জিতেছেন, আর কখনো তার শত্রুরা জিতেছে’
‘এটা কীভাবে সম্ভব যে, আল্লাহর নবীও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন?’
‘এটাই বা কীভাবে সম্ভব যে, আল্লাহর সন্তানকে (নাউযুবিল্লাহ) শূলিতে চড়ানো হয়েছে?’ আলেম হালকা কন্ঠে বললেন।
—
‘আপনাদের সতী নারীর ঘটনা বলুন’ সম্রাট বললেন। মূলত তিনি সুক্ষ্মভাবে হজরত আয়েশা (রা) এর প্রতি অপবাদের সেই ঘটনার দিকে ইংগিত করলেন।
‘আমাদের ইতিহাসে দুজন সতী নারীর কথা পাই। দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্জনরা অপবাদ দিয়েছে। কোরআন দুজনের পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছে। তবে তাদের একজন সন্তানসহ (হযরত মরিয়ম আ.) এসেছিলেন, অন্যজন সন্তান ছাড়া। আপনি কোনজনের কথা বলছেন?’ আলেম হালকা কন্ঠে বলেন।
সম্রাট বিব্রত হয়ে চুপ হয়ে যান।
‘এই ব্যক্তি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কী?’ সম্রাট পাদ্রীদের প্রশ্ন করেন।
‘তাকে সসম্মানে বিদায় দিলেই ভালো। নচেত যেকোনো সময় সে আপনার রাজত্বও কেড়ে নিতে পারে’ প্রধান পাদ্রী বললেন। (১)
—
উপস্থিত জবাবের মাধ্যমে রোমান সম্রাটকে হতভম্ব করে দেয়া এই আলেমের নাম কাজি আবু বকর বাকিল্লানি। তার যুগে তিনি ছিলেন মালেকি মাজহাবের শীর্ষ আলেমদের একজন। ৩৩৮ হিজরিতে তিনি বসরায় জন্মগ্রহন করেন। ইলম অর্জন শেষে তিনি বসরার জামে মসজিদে দরস দেয়া শুরু করেন। অল্পদিনেই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার কাছে ইলম অর্জনের জন্য বিপুল সংখ্যক তালিবুল ইলম ছুটে আসে। (২) পরে তিনি বাগদাদ চলে আসেন, এবং এখানেই ইলমের প্রচার প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কাজি আবু বকর বাকিল্লানি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। তার সম্পর্কে ইমাম যাহাবী লিখেছেন, তার বুঝশক্তি ও মেধা ছিল প্রখর। (৩) দরসের পাশাপাশি লেখালেখিতে তিনি প্রচুর সময় ব্যয় করতেন। বিশেষ করে রাফেজী, খারেজী, মুতাযিলা ও জাহমিয়াদের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল খোলা তরবারীর ন্যায়। খতীব বাগদাদী লিখেছেন, তিনি প্রতিরাতে বিশ রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। তারপর বসে ২৫ পৃষ্ঠা লিখতেন। সকালে লোকজনদের তা পড়াতেন। আবু বকর খাওয়ারেজমী বলেন, বাগদাদের প্রত্যেক লেখকই অন্য লেখকদের গ্রন্থ থেকে সাহায্য নেন। একমাত্র ব্যতিক্রম কাজী আবু বকর বাকেল্লানী। আল্লাহ তার অন্তরকে ইলম দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। (৪)
একবার ইমাম দারা কুতনি এলেন বাগদাদ সফরে। এই সফরে তার সাথে দেখা হলো কাজি আবু বকর বাকেল্লানির। ইমাম দারা কুতনি তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলেন। উপস্থিতরা অবাক হলো। একজন তো মুখ ফসকে বলেই বসলো, আপনি এই সময়ের ইমাম হয়েও তাকে এত সম্মান করছেন?
ইমাম দারা কুতনি বললেন, ইনি মুসলমানদের ইমাম এবং দ্বীনের উকিল কাজি আবু বকর। (৫)
ইমাম আবু বকর বাকিল্লানির যুগটি ছিল রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় অস্থির সময়। আকিদার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল নানা বিভ্রান্তি। তিনি এসব নিরসনের জন্য আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যান। আকিদার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আবুল হাসান আশআরির মাজহাবের অনুসারী এবং তিনি এ বিষয়ে প্রচুর ব্যাখ্যা করেছেন। চার মাজহাবের ইমামদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তিনি রচনা করেছিলেন ‘মানাকিবুল আইম্মাতিল আরবাআ’। ‘এজাযুল কুরআন’ তার আরেকটি অনবদ্য গ্রন্থ।
‘তামহিদুল আওয়ায়েল ওয়া তালখিসুদ দালায়েল’ তার একটি অসামান্য গ্রন্থ যেখানে তিনি ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যদের পক্ষ থেকে ইসলামের উপর আরোপিত নানা প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাব দিয়েছেন। সে সময় মিসরে চলছিল উবাইদিদের শাসন। তারা নিজেকে দাবি করতো ফাতেমি বলে। তারা নিজেদেরকে আহলে বাইত বলে জনগনের কাছে শ্রদ্ধা কুড়াতে চাইতো। কাজি আবু বকর বাকিল্লানি তাদের এই অপচেষ্টার ভিত্তিমূলেও আঘাত করেন। তাদের দাবীর অসারতা প্রমাণ করে তিনি রচনা করেন ‘কাশফুল আসরার’। এই গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেন হজরত ফাতিমা (রা) এর বংশধারার সাথে উবাইদিদের কোনো সম্পর্ক নেই, এবং তারা যে বংশধারা প্রচার করছে তা বানোয়াট। (৬)
কাজি আবু বকর বাকিল্লানির খেদমত শুধু কলমের জগতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উবাইদিরা ইরাক দখলের পায়তারা করলে মোসুলের গভর্নর তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। তখন কাজি আবু বকর বাকিল্লানি আব্বাসি খলিফার পক্ষ থেকে মোসুল সফর করেন এবং গভর্নরকে ভয় দেখিয়ে আব্বাসি খেলাফতের পক্ষে অনুগত থাকতে বাধ্য করেন। তার এই প্রচেষ্টার ফলে উবাইদিদের হিংস্রতা থেকে ইরাক রক্ষা পায়। এর ঘটনার পর তাকে শমসিরে সুন্নত ও লিসানে উম্মত উপাধি দেয়া হয়। (৭)
কাজী আবু বকর বাকেল্লানী ইন্তেকাল করেন ৪০৩ হিজরীতে। তার জানাযায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। শায়খ আবুল ফজল তামিমী তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই ব্যক্তি ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী। সারাজীবনে তিনি ৭০ হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন। (৮)
সূত্র
১। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৭/১৯১-১৯২। তারিখু কুজাতিল আন্দালুস, ৩৭। আল কামিল ফিত তারিখ, ১২৯৫ (বাইতুল আফকারিদ দাওলিয়্যা সংস্করণ)
২। তারতিবুল মাদারিক, ৪/৫৮৫-৫৮৬।
৩। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৭/১৯০।
৪। তারিখু বাগদাদ, ৪/১৫৭।
৫। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৭/৫৫৮।
৬। আল আলাম, ৬/১৭৬।
৭। আল মুন্তাজাম, ১৫/৭৭। আল ইবার, ২/১৯৭।
৮। সিয়ারু আলামিন নুবালা। ১৭/১৯৩।
#সালাফ_পরিচিতি
No comments: