ads

সৌন্দর্যের চর্চা : কিছু সংশয়ের নিরসন

আমাদের কোন কোন ভাই মনে করেন, সুন্দর থাকা, ভালো থাকা, একটু পরিপাটি এবং টিপটপ থাকা; এটা তো দুনিয়াদারদের কাজ। দীনদাররা এগুলোর পিছনে পড়ার প্রশ্নই উঠে না। তারা শুধু আখেরাতের কাজে ব্যস্ত থাকবে; তাদের কাপড় থাকবে সাদামাটা, চুল থাকবে এলোমেলো, আসবাবপত্র থাকবে অগোছালো। আর দামি গাড়ি-বাড়ি লেবাস-পোশাক? দীনদারদের জন্য ওগুলো থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু বাস্তবতাটি কি এমন?

আসলে সৌন্দের্যের কয়েকটি দিক রয়েছে। একটা হচ্ছে চারিত্রিক সৌন্দর্য, মনের সৌন্দর্য, কথাবার্তার সৌন্দর্য এবং আচার-ব্যবহারের সৌন্দর্য। এগুলো যে সবার জন্য অবশ্য কর্তব্য, এটা মোটামুটি সবাই বুঝেন। সৌন্দর্যের অন্যান্য দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুন্দর রাখা, নিজের লেবাস-পোশাক, আসবাবপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং গোছিয়ে রাখা; তওফিক অনুযায়ী সুন্দর, দামী এবং মানসম্মত লেবাস-পোশাক পরা। সৌন্দর্যের এই দিকগুলোকে আমরা গুরুত্ব তো দেই না বরং মনে করি, এটা আমার জন্য করা ঠিক নয়; এটা তো দীনদারদের কাজ নয়।
একারণেই দেখা যায় কেউ একটু সুন্দর এবং দামী পোশাক পরলে কিংবা মূল্যবান আসবাবপত্র ব্যবহার করলে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। আর কেউ যদি নিজের তওফিক অনুযায়ী সুন্দর গাড়ি-বাড়ি ব্যবহার করেন তাহলে তো তিনি পুরোই দুনিয়াদার!
আর শারিরিক সৌন্দর্য? সেটাকে তো কোনো বিষয়ই মনে করা হয় ন। একারণেই দেখা যায় আমাদের অনেকেরই মেদভুঁড়ি অনেক বেড়ে যাচ্ছে এর প্রতি আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বিয়ের আগে যুবকদের অনেকে এগুলোর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ করলেও বিয়ের পরে আর লক্ষ রাখেন না।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি ইসলামে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বলার অপেক্ষা রাখে না। কুরআন এবং হাদিসে এবিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আমি ঐ আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু একটি কথা বলব। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ছিলেন সুফি সাহাবি। সেই সাহাবিও তার ঘরদোর পরিষ্কার রাখার বিষয়ে এত গুরুত্ব দিতেন যে, একটি খড়কুটাও খুঁজে পাওয়া যেতো না। এবার চিন্তা করুন, যিনি ঘরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এত যত্নবান, তিনি নিজের শরীর ও কাপড়চোপড়ের বিষয়ে কতটা যত্নবান হবেন?
সুতরাং আমি যে কাপড়ই পরিধান করব, যে জিনিসই ব্যবহার করব, সেটা পরিচ্ছন্ন রাখব, লেবাস-পোশাক এবং আসবাবপত্রের সৌন্দর্যের এই দিকটার প্রতি লক্ষ রাখা তো সবার জন্য জরুরী। কিন্তু নিজের তওফিক অনুযায়ী দামী এবং মানসম্পন্ন আববাব ব্যবহার করা, সেটার কি প্রয়োজন নেই?
অনেক লোককে দেখা যায়, অঢেল সম্পদের অধিকারী কিন্তু জীবন যাপন খুবই সাদামাটা। অথচ চাইলেই তিনি অনেক দামি কাপড় পরতে পারেন। আবার অনেক লোক আছেন তাদের সম্পদ যেমন আছে খরচও করেন তেমনি। দামি কাপড়, দামি জুতা, দামি গাড়ি। সব কিছুই দামি, সব কিছুই সুন্দর। এই পার্থক্য শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়; আলেম-উলামা, এবং দীনদার শ্রেনীর মধ্যেও এই পার্থক্য দেখা যায়। কেউ খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেন, সাদামাটা থাকেন, কেউ আবার খুব শানশওকতে থাকেন, দামি জামা, দামি জুব্বা, দামি আতর, দামি রুমাল ব্যবহার করেন।
কোনটি উত্তম? সাদামাটা থাকা, নাকি তওফিক অনুযায়ী সুন্দর এবং মানসম্পন্ন আসবাব ব্যবহার করা। এসম্পর্কে দু’রকম হাদিস রয়েছে। কোন হাদীসে একটির প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তো অন্য হাদীসে দ্বিতীয়টির প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আসলে দু’রকম হাদীস এসেছে মানুষের প্রকারভেদের দিকে লক্ষ্য করে। যারা সাদামাটা থাকতে পছন্দ করেন তাদের দু'রকম : ক. কৃপণতার কারণে দামি লেবাস, দামি গাড়ি-বাড়ি পরিহার করেন। খ. সওয়াব প্রাপ্তির ওদ্দেশ্যে সাদামাটা জীবন গ্রহণ করেন।
প্রথম ব্যক্তি কৃপন। তার কাজ গর্হিত। কোরআন-হাদীসে কৃপণ ব্যক্তির অনেক নিন্দা করা হয়েছে যা প্রায় সবারই জানা। দ্বিতীয় ব্যক্তির কাজ প্রশংসিত। আর এমন ব্যক্তির ব্যাপারেই হাদীসে এসেছে- مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسَ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلَائِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَيِّ حُلَلِ الْإِيمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا 'যে ব্যক্তি উত্তম এবং দামি পোশাক পরিহার করে আল্লাহ পাকের কাছে বিনয় প্রকাশের জন্যে; অথচ সে এরকম (দামি, সুন্দর) পোশাক পরতে সামর্থ রাখে। এমন লোককে আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন সকল মাখলুকের অগ্রভাগে ডেকে স্বাধীনতা দিবেন ঈমানের (অর্থাৎ ঈমানদারদেরকে যে কাপড়ের জোড়া দিবেন এগুলোর) যে জোড়া চায় পরিধান করুক’ (সুনামে তিরমিযি, হাদীস: ২৪৮১) অর্থাৎ আল্লাহ তাঅালা তাকে তৌফিক দিলেন, দামি এবং সুন্দর জিনিস ব্যবহার করার; কিন্তু সে বিনয়ের কারণে তা পরিহার করল। এমন লোকের ব্যাপারেই বলা হয়েছে- من ترك اللباس الخ। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-(৪৭৭৮) এ এমনি আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
অপর দিকে যারা শানশওকতে চলেন, তাদের মধ্যেও দুই ধরণের লোক আছে। ক. মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে অর্থাৎ মানুষ যেন তাকে বড়লোক মনে করে, সবাই যেন দেখে বাহবা দেয় এজন্যে। খ. যিনি মনে করেন, আল্লাহ পাক আমাকে এতো নিয়ামত দিলেন, তার নিয়ামতের প্রকাশ করার দরকার, তার নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ দামি লেবাস-পোশাক, দামি আসবাবপত্র তিনি ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, আল্লাহ পাক সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন; তাই আমি সব সময় সুন্দর জিনিস ব্যবহার করব।
প্রথম লোকটির কাজ সম্পূর্ণ অবৈধ, তার কবীরা গোনাহ হবে। তার কাজটি হয়তো রিয়া বা লোক দেখানোর অন্তর্ভুক্ত হবে নতুবা অহংকারের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর উভয়টাই হারাম, যা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর দ্বিতীয় লোকটি প্রশংসিত হবে। এমন লোকের ব্যাপারেই হাদীস এসেছে- إِنَّ اللَّهَ يُحِبَّ أَنْ يَرَى أَثَرُ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার মাঝে প্রদত্ত নিয়ামতের নিদর্শন দেখতে পছন্দ করেন।’ (সুনানে তিরমিযি, হাদীস:২৮১৯) আর এমন ব্যক্তি সম্পর্কেই বর্ণিত হয়েছে-إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَال ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৯২) বুঝা গেল, হাদিসের মাঝে পরষ্পর কোন বিরোধ নেই; বরং একেক প্রকারের লোকের বিবেচনায় একেকটি হাদিস প্রযোয্য হবে।
সুতরাং সম্পদ থাকার পরেও যারা সাদামাটা জীবন গ্রহণ করেছেন, তাদের কেউ কৃপণতার কারণে নিন্দিত, আল্লাহর কাছে অপরাধী; অপরজন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয়ের উদ্দেশ্যে এমনটি করে সে হয়েছে নন্দিত, তার জন্য রয়েছে অনেক বড় পুরষ্কার। আর সম্পদশালীদের যারা খুব শানশওকতে চলেন, তাদের কেউ লোক দেখানো এবং অহংকারবশত করার কারণে তিনি ঘৃণিত এবং আল্লাহর কাছে অপরাধী। তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। আর কেউ দামি জিনিস ব্যবহার করেন, সাথে আছে সুন্দর গাড়ী, সুন্দর বাড়ি; কিন্তু সবই করছেন আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ করার জন্যে। তিনি চিন্তা করেন ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন’ তিন ভাবেন, ‘আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার মাঝে প্রদত্ত নিয়ামতের নিদর্শন দেখতে পছন্দ করেন’ তাই তার সুন্দর পোশাক পরা, সুন্দর গাড়ী চড়া, সুন্দর বাড়িতে থাকা। এজন্যে তিনি নন্দিত ও প্রশংসিত। বাহ্যিক ভাবে উভয়েই তো সমান, পার্থক্য শুধু নিয়তে।

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.