সুরা কাহফের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য
সুরা কাহফ তিলাওয়াতকালে প্রশান্তি নাজিল হয়
বারা ইবনু আজিব রা. বর্ণনা করেন,
ﻛَﺎﻥَ ﺭَﺟُﻞٌ ﻳَﻘْﺮَﺃُ ﺳُﻮﺭَﺓَ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ ﻭَﺇِﻟَﻰ ﺟَﺎﻧِﺒِﻪِ ﺣِﺼَﺎﻥٌ ﻣَﺮْﺑُﻮﻁٌ ﺑِﺸَﻄَﻨَﻴْﻦِ ، ﻓَﺘَﻐَﺸَّﺘْﻪُ ﺳَﺤَﺎﺑَﺔٌ، ﻓَﺠَﻌَﻠَﺖْ ﺗَﺪْﻧُﻮ، ﻭَﺗَﺪْﻧُﻮ، ﻭَﺟَﻌَﻞَ ﻓَﺮَﺳُﻪُ ﻳَﻨْﻔِﺮُ، ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﺻْﺒَﺢَ ﺃَﺗَﻰ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲَّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ، ﻓَﺬَﻛَﺮَ ﺫَﻟِﻚَ ﻟَﻪُ، ﻓَﻘَﺎﻝَ : " ﺗِﻠْﻚَ ﺍﻟﺴَّﻜِﻴﻨَﺔُ ﺗَﻨَﺰَّﻟَﺖْ ﺑِﺎﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ
এক ব্যক্তি[1]সুরা কাহফ তিলাওয়াত করছিলেন। তার ঘোড়াটি দুটো রশি দিয়ে তার পাশে বাঁধা ছিল। তখন এক টুকরো মেঘ এসে তার ওপর ছায়া দান করল। মেঘখণ্ড ক্রমেই নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। আর তার ঘোড়াটি ভয়ে লাফালাফি শুরু করে দিলো। সকাল বেলা যখন লোকটি নবি সাঃ-এর কাছে উক্ত ঘটনার কথা ব্যক্ত করেন, তখন তিনি বললেন, এ ছিল সাকিনা (প্রশান্তি), যা কুরআনের কারণে নাযিল হয়েছিল।[2]
দাজ্জালের মোকাবিলায় সুরা কাহফ
নাওয়াস ইবনু সামআন রা. বর্ণনা করেন,
ﺇِﻥْ ﻳَﺨْﺮُﺝْ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﻓِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﺄَﻧَﺎ ﺣَﺠِﻴﺠُﻪُ ﺩُﻭﻧَﻜُﻢْ، ﻭَﺇِﻥْ ﻳَﺨْﺮُﺝْ ﻭَﻟَﺴْﺖُ ﻓِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﺎﻣْﺮُﺅٌ ﺣَﺠِﻴﺞُ ﻧَﻔْﺴِﻪِ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﻠِﻴﻔَﺘِﻲ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﻣُﺴْﻠِﻢٍ، ﺇِﻧَّﻪُ ﺷَﺎﺏٌّ ﻗَﻄَﻂٌ، ﻋَﻴْﻨُﻪُ ﻃَﺎﻓِﺌَﺔٌ، ﻛَﺄَﻧِّﻲ ﺃُﺷَﺒِّﻬُﻪُ ﺑِﻌَﺒْﺪِ ﺍﻟْﻌُﺰَّﻯ ﺑْﻦِ ﻗَﻄَﻦٍ، ﻓَﻤَﻦْ ﺃَﺩْﺭَﻛَﻪُ ﻣِﻨْﻜُﻢْ، ﻓَﻠْﻴَﻘْﺮَﺃْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓَﻮَﺍﺗِﺢَ ﺳُﻮﺭَﺓِ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ، ﻓَﺈِﻧَّﻬَﺎ ﺟِﻮَﺍﺭُﻛُﻢْ ﻣِﻦْ ﻓِﺘْﻨَﺘِﻪِ
আমি তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়, তবে আমি নিজেই তাকে প্রতিহত করব; তোমাদের প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমি তোমাদের মাঝে না থাকাবস্থায় দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়, তবে প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি নিজের পক্ষ হতে তাকে প্রতিহত করবে। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আল্লাহ তাআলাই হলেন আমার পক্ষ হতে তত্ত্বাবধানকারী। দাজ্জাল ঘন চুলবিশিষ্ট যুবক হবে। তার চোখ হবে আঙ্গুরের মতো। আমি তাকে কাফির আবদুল উজ্জা ইবনু কাতান’র মতো মনে করছি। তোমাদের যে-কেউ দাজ্জালের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন তার ওপর সুরা কাহফের প্রথমোক্ত আয়াতসমূহ পাঠ করে। কারণ, এটাই হবে ফিতনা থেকে তার নিরাপত্তার প্রধান উপায়।[3]
সুরা কাহফ পাঠ করার ফজিলত
আবু সাইদ খুদরি রা. বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
ﻣَﻦْ ﻗَﺮَﺃَ ﺳُﻮﺭَﺓَ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ ﻛَﻤَﺎ ﺃُﻧْﺰِﻟَﺖْ، ﻛَﺎﻧَﺖْ ﻟَﻪُ ﻧُﻮﺭًﺍ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﻣِﻦْ ﻣَﻘَﺎﻣِﻪِ ﺇِﻟَﻰ ﻣَﻜَّﺔَ، ﻭَﻣَﻦْ ﻗَﺮَﺃَ ﻋَﺸْﺮَ ﺁﻳَﺎﺕٍ ﻣِﻦْ ﺁﺧِﺮِﻫَﺎ ﺛُﻢَّ ﺧَﺮَﺝَ ﺍﻟﺪَّﺟَّﺎﻝُ ﻟَﻢْ ﻳُﺴَﻠَّﻂْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ
যে ব্যক্তি সুরা কাহফ যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবে পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন তা তার জন্য নুর হবে, যা তার অবস্থানস্থল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আর যে ব্যক্তি এর শেষ দশ আয়াত পাঠ করবে, এরপর দাজ্জাল বের হলে তাকে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করার শক্তি দেওয়া হবে না।[4]
সুরা কাহফ মুখস্থ রাখার ফজিলত
আবু দারদা রা. বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
ﻣَﻦْ ﺣَﻔِﻆَ ﻋَﺸْﺮَ ﺁﻳَﺎﺕٍ ﻣِﻦْ ﺃَﻭَّﻝِ ﺳُﻮﺭَﺓِ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ ﻋُﺼِﻢَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺪَّﺟَّﺎﻝِ ... ﻗَﺎﻝَ ﺷُﻌْﺒَﺔُ : ﻣِﻦْ ﺁﺧِﺮِ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ، ﻭﻗَﺎﻝَ ﻫَﻤَّﺎﻡٌ : ﻣِﻦْ ﺃَﻭَّﻝِ ﺍﻟْﻜَﻬْﻒِ
যে ব্যক্তি সুরা কাহফের শুরু থেকে দশ আয়াত মুখস্থ রাখবে, সে দাজ্জাল থেকে সুরক্ষিত থাকবে। বর্ণনাকারী শুবার বর্ণনায় এসেছে, প্রথম দশ আয়াতের কথা। আর বর্ণনাকারী হাম্মামের বর্ণনায় এসেছে, শেষ দশ আয়াতের কথা।[5]
হাদিসের অর্থ হচ্ছে,
ﺃﻥ ﻣﻦ ﻗﺮﺃ ﻫﺬﻩ ﺍﻵﻳﺎﺕ ﻭﺗﺪﺑﺮﻫﺎ ﻭﻭﻗﻒ ﻋﻠﻰ ﻣﻌﻨﺎﻫﺎ ﺣﺬﺭﻩ ﻓﺄﻣﻦ ﻣﻨﻪ
যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো পাঠ করবে, এগুলো নিয়ে চিন্তাফিকির করবে এবং এর অর্থ ও মর্মের ব্যাপারে অবগত হবে, সে দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্ক হবে। ফলে তার থেকে নিরাপদ থাকবে।[6]
অর্থাৎ, হাদিসে যে মুখস্থের কথা বলা হয়েছে, এর দ্বারা হাকিকত ও তাৎপর্য না বুঝে স্রেফ তোতাপাখির মতো মুখস্থ করা উদ্দেশ্য নয়। এক হাদিসে আল্লাহ তাআলার উত্তম নামসমূহ (আসমায়ে হুসনা) মুখস্থ করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
ﺇِﻥَّ ﻟِﻠَّﻪِ ﺗِﺴْﻌَﺔً ﻭَﺗِﺴْﻌِﻴﻦَ ﺍﺳْﻤًﺎ، ﻣِﺎﺋَﺔً ﺇِﻟَّﺎ ﻭَﺍﺣِﺪًﺍ، ﻣَﻦْ ﺃَﺣْﺼَﺎﻫَﺎ ﺩَﺧَﻞَ ﺍﻟﺠَﻨَّﺔَ
আল্লাহ তাআলার ৯৯টি, অর্থাৎ একটি কম ১০০টি নাম রয়েছে। যে তা মুখস্থ রাখবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[7]
এর ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল আসির রহ. লেখেন,
ﻣَﻦْ ﺃَﺣْﺼَﺎﻫَﺎ ﻋِﻠْﻤﺎً ﺑِﻬَﺎ ﻭَﺇِﻳﻤَﺎﻧًﺎ .
যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্থ রাখবে এভাবে যে, সে এর ইলম অর্জন করবে এবং এর প্রতি ইমান (সুদৃঢ় বিশ্বাস) রাখবে।
ﻭَﻗِﻴﻞَ : ﺃَﺭَﺍﺩَ ﻣَﻦ ﺃَﻃَﺎﻕَ ﺍﻟﻌَﻤَﻞ ﺑِﻤُﻘْﺘَﻀَﺎﻫَﺎ، ﻣِﺜْﻞ ﻣَﻦْ ﻳَﻌْﻠﻢ ﺃَﻧَّﻪُ ﺳَﻤِﻴﻊٌ ﺑَﺼِﻴﺮٌ ﻓﻴَﻜُﻒُّ ﻟﺴﺎﻧَﻪ ﻭﺳَﻤْﻌﻪ ﻋﻤَّﺎ ﻟَﺎ ﻳَﺠُﻮﺯُ ﻟَﻪُ، ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﺑَﺎﻗِﻲ ﺍﻟْﺄَﺳْﻤَﺎﺀِ .
আরেকটি মত হচ্ছে, সে এগুলোর দাবির আলোকে আমল করবে। উদাহরণস্বরূপ, যে ব্যক্তি জানে, আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। সে তার এই ইলমের আলোকে তার জিহ্বা ও শ্রবণেন্দ্রিয়কে নাজায়িয বিষয় থেকে দূরে রাখবে। অন্যান্য নামগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা।[8]
আল্লামা মুহাম্মাদ তাহের পাটনি রহ. লেখেন,
‘আখেরি জামানার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুসিবত হবে দাজ্জালি ফিতনা। এর থেকে হেফাজত লাভের জন্য হাদিস শরিফে সুরা কাহাফ নিয়মিত তেলাওয়াত করার তাকিদ করা হয়েছে। যেভাবে আসহাবে কাহাফ জালিম বাদশাহর কুফরি ফিতনা থেকে ইমানসহ হেফাজত ও নিরাপদ ছিল, সুরা কাহফের আমলকারী ব্যক্তিও এভাবে হেফাজত ও নিরাপদ থাকবে। এছাড়াও প্রত্যেক ওই দাজ্জাল (ধোঁকাবাজ), যে কথা ও কাজের মাধ্যমে ধোঁকাবাজি করে, সুরা কাহফের আমলকারী তার ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। দাজ্জালের আশ্চর্যজন চেহারা-সুরত, স্বভাব-প্রকৃতি, আচরণ ও নিদর্শন এ সুরার বিভিন্ন আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রতি মনোযোগী হবে এবং এর আয়াতসমূহ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করবে, সে কোনো ফিতনায় ফাঁসবে না।
আমার মনে হয়, সুরা কাহফের এ স্বাতন্ত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির কারণে, যা রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর জানা ছিল।’[9]
সায়্যিদ আবুল হাসান আলি নদবি রহ. লেখেন,
‘সুরা কাহফ কুরআনের জরুরি এমন একটি একক সুরা, যাতে শেষ জামানার ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের ফিতনা থেকে বাঁচার সবচেয়ে বেশি উপায়-উপকরণ রয়েছে। যার মধ্যে দাজ্জালের ফিতনা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এ সুরায় ফিতনাসমূহের গতি ও প্রকৃতি যেভাবে বর্ণিত আছে, তেমনি তেমনি তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পন্থাও নির্দেশিত রয়েছে। সুরা কাহফে এমন সতর্কবাণী রয়েছে, যা দাজ্জালের মতো ভয়ংকর ফিতনাকেও রুখে দিতে পারে এবং দাজ্জালের প্রভাব-প্রতাপকে পরাস্ত করতে পারে। এ সুরা যেভাবে আখেরি জামানার ফিতনাগুলো চিহ্নিত করতে পারে, তেমনি সেগুলো নিশ্চিহ্নও করতে পারে। ছোট-বড় যেকোনো ফিতনাকেই এই সুরা নির্মূল করতে পারে। কেউ যদি এ সুরার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক করে নেয় এবং এর অর্থ ও মর্ম প্রাণে গেঁথে নেয়, যার পদ্ধতি হলো, এ সুরা মুখস্থ করে নেওয়া এবং বেশি বেশি তেলাওয়াত করা, তাহলে সে কিয়ামতপূর্ব সব ধরনের ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবে। দাজ্জালের মতো ভয়ংকর ফিতনা থেকেও মুক্ত ও নিরাপদ থাকবে।’
- আলী হাসান উসামা (হাফি.)
.
পাদটীকা
[1] তিনি ছিলেন উসায়দ ইবনু হুজায়র। [ফাতহুল বারি, ইবনু হাজার]
[2] সহিহ বুখারি : ৫০১১ । সুরা কাহফের ফজিলত অধ্যায়।
[3] সহিহ মুসলিম : ২৯৩৭; সুনানু আবি দাউদ : ৪৩২১
[4] আল-মুসতাদরাক, ইমাম হাকিম : ২০৭২
[5] সহিহ মুসলিম : ৮০৯-৮১০
[6] আওনুল মাবুদ শারহু সুনানি আবি দাউদ
[7] সহিহ বুখারি : ৭৩৯২
[8] আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিসি ওয়াল আসার : ১/৩৯৭
[9] মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার
No comments: