খ্যাতি কামনা
সময় বদলে গেছে। তাই মানুষও বদলে গেছে। বদলে গেছে সবার চিন্তা-ভাবনা। অনেক কিছুর মানদণ্ডই আর আগের মতাে নেই। একসময় যা আমাদের সালাফদের জন্য ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক, আজ বহু মানুষ সে জিনিসের পিছনেই ছুটছে। সেটাকেই জীবনের একমাত্র সফলতা মনে করছে। যেটার কথা মনে হলে তাদের মন বিষাদে ছেয়ে যেত, আজ অনেকের মন সেটার জন্য আকুল হয়ে আছে।
কী সেটা?
.
খ্যাতি। মানুষের প্রশংসা পাওয়া। সবার মুখে মুখে নিজের নাম ছড়িয়ে পড়া। তবে যাদের মনটা আখিরাতের সাথে জুড়ে ছিল, তাঁরা কখনাে এ দুনিয়ার সস্তা সুনাম চাননি। মানুষের মুখে বাহবা না পেলে তাঁরা মন খারাপ করতেন না। কারণ, তাঁরা আল্লাহর জন্য কাজ করতেন। তাঁর কাছেই প্রতিদান চাইতেন।
.
তাই তাঁরা খ্যাতি থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। লাইমলাইটে নয়, বরং পর্দার অন্তরালে থেকেই কাজ করতে ভালােবাসতেন। সামান্য আত্মতুষ্টি তাদের ভালাে আমলগুলােকে নষ্ট করে দেয় কিনা, এ ভয় তাদের সব সময় তটস্থ করে রাখত। ইবনে মুহাইরীয(র.) এই বলে আল্লাহর নিকট দু’আ করতেন,
.
“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাই (সবার নিকট যেন আমার) বেশি সুনাম না থাকে।”
[তাফসির ইবন কাসির ৬/৩৪২]
.
তাঁরা পাদপ্রদীপের আলাে থেকে দূরে থাকতে চাইতেন। বারবার আল্লাহর নিকট মানুষের সুনাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। তারা চাইতেন, মানুষের নিকট অপরিচিত হয়ে বাঁচতে। অতি সাধারণ একজন হিসেবেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে। সামান্য কিছু খাবার খেয়ে জীবনধারণ করতে। একজন দাস যেভাবে মাটিতে বসে, সেভাবেই বসতে।
.
... ... ইব্রাহিম ইবন আদহাম(র.) এই বলতেন, “যে খ্যাতি কামনা করে, সে আসলে আল্লাহর প্রতি আন্তরিক নয়।”
[সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৩৯৩]
.
যখন আইয়ুব আস সিখতিয়ানি(র.) কোনাে মজলিসের পাশ দিয়ে যেতেন, তাদের সালাম দিতেন। সবাই তাঁকে চিনতে পেরে উচ্ছ্বাসের সাথে সালামের উত্তর নিত। এটা দেখে তিনি আফসােস করে বলতেন,
.
“যেন আমাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। যেন আমাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।”
তিনি বলতেন, “আমার ভয় হয় খ্যাতির কারণে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে। আমাদের কোনাে ভালাে আমলই থাকবে না।”
[তাওয়াদূ'য়ু খুমুল লি ইবনে আবিদ দুনিয়া হাদিস নং: ৫৬]
.
তাঁরা ভিআইপি টিকেট চাইতেন না। আলাদা প্রটোকল কামনা করতেন না। এমন মানুষ হয়তাে আমাদের সময়েও রয়েছেন। তাঁদের কয়জন ফলােয়ার হলাে, স্ট্যাটাসে কয়টা লাইক পড়ল, এটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাঁরা শুধু আল্লাহর জন্য কাজ করে যান। কে কী বলল, সমালােচনা করল না প্রশংসা করল, তা নিয়ে তাঁদের ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই।
.
... ... সংখ্যা দিয়ে কি ভালাে কাজ মাপা যায়? একজন মানুষের অনেক ফলােয়ার থাকতে পারে। হতে পারে তাঁর কথা বহু মানুষ শােনে। কিন্তু সে কথা তাদের জীবন বদলে দেয় না। আবার আরেকজনের কথা হয়তাে সামান্য কিছু মানুষ শোনে, কিন্তু সে কথা তাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। অন্তরটাকে আল্লাহর স্মরণে বিগলিত করে দেয়। মুখ দিয়ে আসা কথা তাে কান পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু যে কথা অন্তর থেকে আসে, তা অন্তরেই পৌঁছায়।
.
আপনাকে ফলাে করে এমন মানুষ কি খুবই কম?
.
তাহলে আল্লাহ তা'আলাকে ধন্যবাদ দিন। কারণ, এখন আপনার ভুলগুলাে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। মানুষের দিকে না তাকিয়ে আপনার পক্ষে আল্লাহর দিকে ফোকাস করা সহজ। আপনার মনে অহংকার দানা বাঁধার সম্ভাবনা কম। নিজেকে বড় ভাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
.
রাসূল(ﷺ) বলেছেন,
.
“ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যে ঘােড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে প্রস্তুত রয়েছে। তাঁর চুল এলােমেলাে, পা ধূলিময়। তাঁকে পাহারায় রাখা হলেও সে সন্তুষ্ট, আবার একদম পেছনের কাতারে রাখা হলেও সে খুশি। সে কারও সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাঁকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোনাে বিষয়ে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ হয় না।”
[সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ২৮৮৬]
.
আজও বহু মানুষ মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকছে। আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছে। তাঁদের মধ্যে কজন খ্যাতি থেকে দূরে থাকতে চান? সবার চােখ ধাঁধিয়ে নয়, বরং পর্দার অন্তরালে নীরবে কাজ করে নিজের জীবনটাকে ইসলামের জন্য বিলিয়ে দিতে চান?
যে পথে আমাদের দুনিয়াবিমুখ সালাফরা হেঁটেছেন, সে নীরস পথে হাঁটতে আমরা ক'জন রাজি আছি?
.
No comments: