ads

পশ্চিমা লেন্সে ইসলাম

 মানুষ শূন্যতার মাঝে বেড়ে ওঠে না। সমাজ, সংস্কৃতি, সময় ও পরিস্থিতি আমাদের চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাসকে শুধু প্রভাবিতই করে না, বরং আমাদের পুরো চিন্তার কাঠামোও ঠিক করে দেয় এধরনের ফ্যাক্টরগুলো। আমরা পৃথিবীকে দেখতে শিখি একটা নির্দিষ্ট লেন্সের ভেতর দিয়ে, একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে। আর যেহেতু ছোটবেলা থেকেই এই লেন্সের ভেতর থেকে আমরা পৃথিবীকে দেখছি তাই কোথায় লেন্সের শেষ হয় আর কোথায় পৃথিবীর শুরু, সেটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।

.
ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করা যায় – জনবিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে শৈশব থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা একদল কালারব্লাইন্ড মানুষের পৃথিবীর অদ্ভূত সুন্দর নানান রঙের বর্ণালী নিয়ে কোন ধারণা থাকবে না। কেউ এসে হরেক রকমের উজ্জ্বল রঙের কথা বলা শুরু করলে তারা নির্ঘাত সেই মানুষটাকে পাগল ঠাউরাবে। প্রথম প্রথম তো মানতে চাইবেই না, লম্বা সময় নিয়ে যুক্তি-প্রমান দিয়ে বোঝানোর পরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়তো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের কাছে এটাই বাস্তবতা। এটাই তাদের কাছে অবিসংবাদিত সত্য।
.
অথবা এমন একজন মানুষের চিন্তা করুন, যে জন্মের পর থেকে ছোট্ট একটা ঘরে বন্দী। ঘরের এক দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা। এই জানালা বাইরের দুনিয়ার সাথে তার সংস্পর্শের একমাত্র মাধ্যম। জানালার কাঁচটা নির্দিষ্ট একটা রঙকে বেশি ফুটিয়ে তোলে। ধরা যাক, এই নির্দিষ্ট রঙটা হল হলুদ। কুড়েঘরের এই বন্দী পৃথিবীকে দেখে হলুদ রঙ্গের এক আভায়। গাছ, পাতা, পাখি, ফুল, ঘাস, আকাশ, সাগর, সব কিছুকে সে দেখে হলুদ রঙ্গের ফিল্টারের মধ্য দিয়ে। সে ধরে নেবে বাইরের দুনিয়াটা হলদেটে। সমস্যাটা তার চোখে না। বায়োলজিকালি তার মস্তিষ্কেও কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা জানালার কাঁচে। হলুদ রঙের কাঁচ আমাদের এই বন্দীর চিন্তাকে আটকে ফেলেছে একটা নির্দিষ্ট রঙে। গ্রিক দার্শনিক প্লেইটোর বিখ্যাত ‘গুহার গল্প’-এ অনেকটা একই রকমের একটা উদাহরণ দেয়া আছে।
.
কথাগুলো বলার কারণ হল আমাদের বাস্তবতাটা বোঝা। আমাদের চোখেও একটা চশমা দেয়া থাকে। একটা ফিল্টার, একটা লেন্স থাকে। এর ভেতর দিয়ে আমরা বাস্তবতা দেখি। এই লেন্সের রঙে গড়ে ওঠে আমাদের চিন্তাচেতনা। আমরা নিজেদের চিন্তাচেতনাকে ‘আনবায়াসড’ ভাবতে পছন্দ করি, কিন্তু কর্তৃত্বশীল সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন, মিডিয়া ইত্যাদির কারণে তৈরি হওয়া বায়াস আমাদের চিন্তায় থেকে যায়। এ বায়াস থেকে বের হতে হলে সচেতনভাবে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদি আমরা এই বায়াস কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা সব সময় বাস্তবতাকে দেখবো ওপরের কালারব্লাইন্ড কিংবা কুড়েঘরের বন্দীর মতো। এমনকি আমাদের চোখে যে লেন্স দেয়া আছে হয়তো এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরও সেটা আমরা বুঝতে উঠতে পারবো না।
.
আজ আমাদের চোখে সেটে থাকা লেন্সটা পশ্চিমা। এই লেন্সের মধ্য দিয়ে আমরা যখন ইসলামকে দেখি তখন অনেক কিছু মেনে নেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ইসলামের অনেক কিছু আমাদের কাছে ‘যৌক্তিক’, ‘আধুনিক’ কিংবা ‘উপযুক্ত’ মনে হয় না। ইন ফ্যাক্ট, ইসলামের মধ্যে এমন অনেক কিছু আমরা দেখি যেগুলোকে মনে হয় ছোটবেলা থেকে মুখস্থ করা ধ্যানধারণাগুলোর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। ইসলামের প্যারাডাইম, পশ্চিমা প্যারাডাইমের চেয়ে আলাদা। ব্যাপকভাবে আলাদা।
.
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বাস্তবতা, জ্ঞান এবং নৈতিকতার যে শিক্ষা আমরা পাই সেটা পশ্চিমের ব্যাখ্যার সাথে মেলে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ দুটো অবস্থান সাংঘর্ষিক। এ সংঘাতের সমাধান না করা হলে দুটো বিপরীতধর্মী বিশ্বাস একসাথে ধারণ করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় কগনিটিভ ডিযোন্যান্স। এমন অবস্থায় কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কেউ চেষ্টা করে পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা দিতে। আর যাদের ওপর আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জাল রহমত করেছেন তারা পশ্চিমা লেন্সটা খুলে ফেলে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে শেখে আল্লাহর কাছে।
.
ইসলামের বিভিন্ন বিধান নিয়ে আজ যে আমরা ‘খটকায়’ থাকি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কারণ হল এই দুই প্যারাডাইমের সংঘর্ষ। গোলমালটা লাগে পশ্চিমা প্যারাডাইমের ভেতর থেকে ইসলামকে বিচার করার চেষ্টা থেকে। কটকটা হলুদরঙ্গা লেন্সের ভেতর দিয়ে নীল সমুদ্রকে খুব একটা সুন্দর লাগার কথা না। চোখের সামনে থেকে এই লেন্স যে সরাতে পারবে না, সমুদ্রের সৌন্দর্য নিয়ে লেখা সব কবিতা, সব কথা সারাজীবন তার কাছে বেখাপ্পা কিংবা ভুল মনে হবে। মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে সমুদ্রের সৌন্দর্য এক ফোঁটা কমবে না। সমুদ্র যে সুন্দর, বদলাবে না এই সত্য।
.
এটা আশা করে বসে থাকা যাবে না যে কটকটা হলুদ লেন্সের মধ্যে দিয়েই সমুদ্রকে সুন্দর লাগতে হবে। তা না হলে সমুদ্র কুৎসিত। সমুদ্রকে দেখতে হলে চোখের সামনে থেকে লেন্স সরাতে হবে।

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.