ads

মূর্তি-ভাষ্কর্য ও রাষ্ট্রের মালিকানা

 এক.

আজকে কম্প্যারেটিভ পলিটিক্স ক্লাসে গ্রুপ প্রেজেন্টেশন ছিল। আমাদের গ্রুপ বাংলাদেশের উপর প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর আমার বাহরাইনী ক্লাসমেট আমাকে এসে বলল আমি বাংলাদেশের উপর প্রেজেন্ট করে কাজটা ভাল করি নাই। কারণ আমি অলরেডি বাংলাদেশের উপর প্রচুর জানি। কাজেই আমাকে প্রেজেন্টেশনের জন্য আলাদা করে রিসার্চ করতে বা প্রিপারেশন নিতে হয় নাই। তো উত্তরে আমি বললাম যে ও নিজেও তো চাইলে বাহরাইনের উপর প্রেজেন্টেশন দিতে পারে। এরপর খানিকটা ব্যান্টারিঙ আর স্মল টকের পর আমি ওকে খোঁচা দিয়ে বললাম, তোমার দেশ বাহরাইন না ইজরায়েলকে রিকগনাইজ করেছে? বেচারার স্বাভাবিক হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এরপর বলল, আমাদের দেশ তো আর আমরা চালাই না; রাষ্ট্র আর জনগন তো দুই মেরুর। রাষ্ট্র জনগনকে ঘৃণা করে আর জনগন রাষ্ট্রকে ঘৃণা করে।
দুই.
একাডেমিয়াতে রাষ্ট্রের মালিকানা নিয়ে ইদানিং প্রচুর কথা হচ্ছে। রাষ্ট্রকেন্দ্রীকতা বা statism নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রচুর ক্রিটিসিজম হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান তত্ত্বগুলি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তাদের রাষ্ট্রকেন্দ্রীকতার। যেমন, আপনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক লিটারেচারে হরহামেশাই দেখতে পাবেন যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাকি অনেক ভাল। অথচ উভয় দেশের জনগনের কাছে গেলেই সম্পর্কের গভীরতা আর ভাল-খারাপ সব দিক সম্পর্কেই আমরা বুঝতে পারছি। তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এই যে রাষ্ট্রকে একক ধরে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়, এইগুলার কার্যকারিতা কি?
এই প্রশ্নের পরবর্তী প্রশ্নটা হচ্ছে তাহলে রাষ্ট্রটা আসলে কে চালায়। এটা একদম প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে গেছে যে আধুনিক রাষ্ট্রের মালিকানা আসলে জনগনের নয়। এটা শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে না বরং পশ্চিমের ক্ষেত্রেও সত্য। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রন করে এলিটরা। আমেরিকার ক্ষেত্রে যেমন বিজনেস লবির ব্যাপারটা সমস্ত এম্পিরিকাল এভিডেন্স দ্বারা সত্য প্রমাণিত । বিজনেস লবি ইলেকশন ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স করে এবং তারা যা চায় আল্টিমেটলি তাই হয় সাধারণ মানুষ কি চায় না চায় তার কোন গুরুত্ব নাই। শুধু আমেরিকা না। ইউরোপের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য (Aizenberg and Hanegraff, 2019)। একারণেই অনেক তাত্ত্বিক পশ্চিমা দেশগুলিকে আর গণতন্ত্র বলেন না। বরং তারা পশ্চিমের দেশগুলিকে বলছেন plutocracy বা ধনিকতন্ত্র (e.g. Sayyid, 2014)। এবং একটা হাইপোথিসিস হচ্ছে রাষ্ট্রের সাথে জনগনের এই বিশাল দূরত্বের কারণেই পশ্চিমে পপুলিজমের উত্থান ঘটছে।
তিন.
লিবারেল ডেমোক্রেসি একটা প্রতারণা। থিওডেমোক্রেসি শুনলে যেমন অনেকের হাসি আসে, লিবারেল ডেমোক্রেসি এর চেয়েও বড় হাস্যকর। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা tyranny of majority নিয়ে মারাত্মকভাবে শঙ্কিত ছিলেন। তারা মনে করতেন পরিপূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম হলে গরীবরা ধনীদের সম্পদ কেড়ে নিবে। একারণে তারা বলতেন আমেরিকা ডেমোক্রেসি না, আমেরিকা হচ্ছে রিপাবলিক। একারণেই দেখবেন আমেরিকাত এত চেক এন্ড ব্যালান্স - কোনভাবেই যেন জনসাধারণ ক্ষমতায় না আসতে পারে (Latham, 1997: 27; Zakaria, 2003)। এটা হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্রেসির মজ্জাগত কন্ট্রাডিকশন। একদিকে বলা হচ্ছে সকল মানুষ সমান, ওয়ান পারসন ওয়ান ভোট, অন্যদিকে প্রাইভেট প্রোপার্টির মাধ্যমে সমাজে বৈষম্যিকে কানুনী ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে (Bowles and Gintis, 1987; Held, 1995)।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও এর একটা কালচারাল দিকও আছে। এখানে elite sensibility গনমানুষের এক্সপেক্টেশন, এস্থেটিক, মূল্যবোধকে দলিত করে।
"Democracy and freedom are central to "Western Civilization," and the universal right to free speech is central to democracy. Or is it? How does the idea of cultivating elite sensibilities (quality) implied by "civilization" fit with the idea of mass equality (quantity) implied by "democracy"?" (Asad, 2013: 20)
চার.
সারা বিশ্বেই একারণে লিবারেলিজমের ধাপ্পাবাজি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমেরিকার দিকে তাকান। সেখানে আপনি যদি ইলেকশন রেজাল্ট দেখেন তাহলে দেখবেন পপুলার ভোটে বাইডেন এগিয়ে। কিন্তু ব্যাপক জনবহুল শহর বা ধনী, অভিজাত উপশহরের বাসিন্দারাই বাইডেনের সাপোর্টার। হিলারির ক্ষেত্রেও তাই। লিবারেলদের ক্ষেত্রেই তাই। কিন্তু যদি আপনি শহরগুলি বাদ দিয়ে বাকি আমেরিকার ক্ষেত্রে চিন্তা করেন- সেখানে ট্রাম্পের জয়জয়কার। অর্থাৎ, ভৌগলিক আয়তনের দিক থেকে লিবারেলরা আমেরিকার খুব সামান্য টেরিটরিকেই রিপ্রেজেন্ট করে।
বাংলাদেশের মত গ্রাম বা মফস্বলে অধিকাংশ লোক বাস করা দেশের ক্ষেত্রে অবস্থাটা আরও মারাত্মক। এখানে ওভারওয়েল্মিং মেজরিটি লিবারেল না। কিন্তু লিবারেল এলিট জোর করে মানুষকে লিবারেল মানাবেই। এনলাইটেন্ড হবেন না মানে? আপনার বাপ এনলাইটেন্ড হবে। আপনি "ভাল মানুষ" হইতে না চাইলে রাষ্ট্রকে দিয়ে লিবারেলরা জোর করে আপনাকে "ভাল মানুষ" বানাবে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নামক ইন্ডক্ট্রিনেশন টুল, পুশ ফ্যাক্টর, পুল ফ্যাক্টর সব ব্যবহার করে আপনাকে আলোকিত মানুষ বানানো হবেই। কনভার্ট না হয়ে যাবেন কোথায়?
পাঁচ.
কাটিং এজ কনসেপচুয়ালাইজেশনে বাংলাদেশের মত দেশগুলাকে ফ্রন্টিয়ার রাষ্ট্র (frontier state) বলা হয়। ফ্রন্টিয়ার হচ্ছে সাম্রাজ্যের বাইরে একটা দূর্গের মত যেটার দায়িত্ব হচ্ছে barbarianদের প্রতিহত করা (Hirst, 2005: 77)। সাম্রাজ্যের সুরক্ষার জন্য ফ্রন্টিয়ার খুবই জরুরী। ফ্রন্টিয়ার সোসাইটি হচ্ছে বর্বর, অশিক্ষিত, গান্ডু, মূর্খ জনগনের সমাজ (Geiger, 2002)। এই গান্ডু সমাজে ফ্রন্টিয়ার স্থাপন করে গান্ডুদের বশে আনতে হবে এবং সভ্য বানাতে হবে (Newman and Passi, 1998:189).
প্রাচীন সাম্রাজ্যের এই যুক্তি বর্তমানেও সচল আছে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ফ্রন্টিয়ার স্টেট। এই রাষ্ট্রগুলা সাম্রাজ্যের জন্য ফ্রন্টিয়ার। রাষ্ট্রের জনগন হচ্ছে ফ্রন্টিয়ার সোসাইটির অধিবাসী। এই গান্ডু সোসাইটি সভ্য বানানোর দায় ফ্রন্টিয়ার রাষ্ট্রের। এটা শুধু ভূরাজনীতি বা geopolitics এর ব্যাপার না। এটা biopolitics এর ব্যাপার। অর্থাৎ, ফ্রন্তিয়ার সমাজের মানুষের জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রন করার ব্যাপার (Duffield, 2001, 2005). ওয়ার অন টেররের জামানায় এই ফ্রন্টিয়ার রাষ্ট্র লিবারেল শান্তি (liberal peace) নিশ্চিতকল্পে আরও জরুরীঃ
"The new political economy of danger, as defined by the 'global war on terror,' 'means that 'everywhere' becomes strategically critical. The global borderlands [third world countries] are too dangerous to be left alone. Liberal wars, a boundless, limitless form of warfare, have dismantled traditional conceptions of state boundaries (Goodhand, 2008: 229).
পশ্চিমের ধনিকতন্ত্রের চেয়ে লিবারেল সাম্রাজ্যের ফ্রন্টিয়ার স্টেট তথা মুসলমান দেশগুলার অবস্থা করুন। এই রাষ্ট্রগুলিতে শুধু রাষ্ট্র আর জনগনের মধ্যে বিশাল disconnect আছে তাই নয়। মুসলমান দেশগুলি হচ্ছে security state। পুলিশি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রগুলি জনগনকে প্রতিনিধিত্ব করতে নয়, জনগনকে নিয়ন্ত্রন করার জন্যই ফাংশন করছে। তাত্ত্বিকগণ একে mukhbarat state ও বলে। মুসলমান রাষ্ট্রসমূহ তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সশস্ত্র বাহিনী বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজ দেশকে রক্ষার জন্য নয় বরং জনগনকে দমন করার জন্যই তৈরী। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই আমরা এটা বুঝতে পারি (Sayyid, 2014)।
ছয়.
অনেকে হয়ত চিন্তা করছেন ভাষ্কর্য-মূর্তি বিতর্কে কেন এত অপ্রাসঙ্গিক একাডেমিক আলাপ করলাম। আসলে ভাষ্কর্য-মূর্তি বিতর্কে এটাই সবচেয়ে জরুরী আলাপ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা আসলে কার হাতে? পাবলিক স্পেসে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কি নির্মিত হবে না হবে, সেটা কে নির্ধারণ করবে? স্লিভলেস ব্লাউজ পরা, বিশাল গোল টিপ পরা কোলকাতাপন্থী "সুশীল"রা? নাকি চোশ্ত আংরেজী বলা আইবিয়েটরা? নাকি হুমায়ুন আজাদের বান্দা বুয়েটের ঐ ছেলেরা যারা মনে করে আবরার ছিল পটেনশিয়াল জঙ্গী? নাকি বাংলাদেশের জনগন? এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেন নাই সেই প্রশ্নের উত্তরও এর মধ্যে নিহিত। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির দুইজন গবেষকের রিসেন্ট একটা খুবই রিলায়েবল এম্পিরিক্যাল স্টাডি আমাদের দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সেকুলাররা গণতন্ত্র অতটা পছন্দ করেন না কিন্তু ইসলামপন্থীরা গনতন্ত্রের পক্ষে (Fair and Patel, 2019)। যদিও এই দুইজন গবেষক কারণ অনুসন্ধানে অতটা গভীরে জান নাই, কিন্তু এই ফাইন্ডিংসটা কিন্তু মারাত্মক।
বাংলাদেশের সবাই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। ভালোবাসে না বরং সেকুলাররা। সেকুলারদের অন্যতম প্রিয় দেবতা "ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর" আলী রিয়াজ তাঁর প্রচুর আর্টিকেল-বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ইসলাম টিকে থাকার জন্য দোষ দিয়েছেন (e.g. Riaz, 2004)। আরেক সেকুলার দেবী সুলতানা কামাল তাঁর আর্টিকেলে বঙ্গবন্ধুকে গালিগালাজ করেছেন। রেডিও টেলিভিশনে কেন কোরান তেলওয়াত হয়, আযান প্রচারিত হয়, কেন রাষ্ট্রপতিরা হজ্বে যান, কেন বঙ্গবন্ধু OIC তে যোগ দিলেন, কেন বঙ্গবন্ধু "Godless atheism" কে মেনে নিলেন না এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর সুলতানা কামালের ক্ষোভ চোখে পড়ার মত (Kamal, 1990)। অথচ এরপরও সেকুলাররা বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য চাচ্ছে। মজার ব্যাপার না?
এটা আসলে পূর্বোল্লোখিত biopolitics এর অংশ। কিভাবে বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবে সেটা সাম্রাজ্যের দালালদের কাছ থেকে বাংলাদেশীদের জেনে নিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ বানিয়ে, সবচেয়ে আধুনিক লাইব্রেরী বানিয়ে, সবচেয়ে ভাল মাদ্রাসা-জামেয়া বানিয়ে, কিংবা পাড়ার মোড়ে মড়ে বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তিগুলির ক্যালিগ্রাফি তৈরী করে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশীরা সাম্রাজ্যের দালালদের দেখানো তরিকাতেই কেবল ভালোবাসতে হবে। এই যে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করার biopolitics সেটাই আমরা বাংলাদেশে দেখছি।
তাত্ত্বিক Santiago Zabala এর বরাত দিয়ে তালাল আসাদ লিখছেন, "Secularization [...] is not merely produced by a Christian past but is also a testament to the enduring presence of Christianity in its post-Christian mode (European civilization)" (Asad, 2013).
ব্রিটেনে রাষ্ট্রধর্ম প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রিশ্চিয়ানিটি, আমেরিকার সংবিধানে In God we trust কিংবা জার্মানীর শাসক দলের নাম ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন হওয়া সত্ত্বেও সেসব দেশে সেকুলারিজম কিন্তু হুমকির মুখে নাই। কারণ ক্রিশ্চিয়ানিটি সেকুলারিজমের জন্মদাতা, ধারক। কিন্তু বাঙ্গালী গান্ডু কখনো সেকুলার হতে পারবে না, সেকুলারিজমের প্রডিউসার হতে পারবে না কারণ বাঙ্গালী আনফরচুনেটলি মুসলমান।
পশ্চিমে যেকোন মূর্তি/ভাষ্কর্য বসানোর আগে পাবলিক অপিনিয়ন নেওয়া হয়, ট্যাক্সপেয়ারদের জবাবদিহিতার দরকার হয়। বাংলাদেশে এসবের বালাই নাই। সাম্রাজ্যের দালালরা শুধু তাদের এস্থেটিক আর জীবনদর্শন বাঙ্গালীর ওপর চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হবে না, এজন্য অর্থায়নটাও বাঙ্গালীকেই করতে হবে।
মূর্তি/ভাষ্কর্য বাহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে এটাইঃ বাংলাদেশ, তুমি কার? বাঙ্গালীর? নাকি ফ্রন্টিয়ার রাষ্ট্রের ক্রুসেডারদের? জনতার নাকি দালালের? বাংলার নাকি বহিরাগতদের?
এই সওয়ালের মোকাবেলা আমাদের সবচেয়ে বেশী জরুরী।

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.