ads

সীরাহ ও আরবি ভাষা শেখা

 এত এত যুক্তি, রেফারেন্স, খণ্ডন, তর্কাতর্কি, বিশ্লেষণ, চিন্তা-প্রতিচিন্তার হরেক রকম টানাপোড়েনে হারিয়ে যায় ঈমানের সরলতা। খালিকের সাথে মাখলুকের সরল সম্পর্ক, যেখানে প্যাঁচগোচ নেই, যে সম্পর্কের সাথে ব্যাখ্যা-প্রমাণের দাবি নেই, সেই সাদাসিধা সম্পর্কের স্বাদ হারিয়ে যায়। প্রাণের টান হারায়, নির্জনে কিয়ামের দুর্নিবার আকর্ষণ হারায়, মুনাজাতে ঝরঝর বরষা হারায়, মালিকের উপস্থিতির অনুভূতি হারায়, তাতমাইন্নুল ক্বুলুব (হৃদয়ের শীতলতা) হারায়।

এসব ফিরে পেতে নিজের গহীনে নিজে ডুব দিতে হয়। নিজেকে সময় দিতে হয়। সবাইকে সময় দেয়া হয়, অভাগা এই নিজেকে দেবার সময় নেই। নফল ইতেকাফ নামে যে একটা আমল আছে, উম্মাহ মনে হয় ভুলেই গেছে। নিজের গোড়ায় পানি ঢালার কথা মনেই নেই পানিওয়ালার।
৩ দিনের জামাত, চিল্লা শব্দগুলো পছন্দ না হলে থাক, সরিয়ে রাখুন। মাঝে মাঝে দলবল হয়ে নফল ইতেকাফে যান। ৩ দিন সংখ্যাটা পছন্দ না হলে ২ দিন, ৪ দিন, ৭দিনের জন্য যান। ৪০ দিন/চিল্লা শব্দটা পছন্দ না হলে, ১৫ দিন, ২০ দিনের জন্য যান। তাবলীগ সহ্য না হলে বাদ, নিজেরা মিলে যান। নিজেকে নিজে সময় দেবার জন্য যান। সাথে একজন আলিম-কে নিন। দূরে যেতে মন না চাইলে কাছের কোনো মসজিদে যান। কাছে গেলে অবশ্য নিজেকে সময় দেয়া হয়ে ওঠে না, সেই ব্যস্ততাই ঘিরে ধরে আবার, পাশের উপজেলায় যাওয়া উচিত।
কী করব এটা করে? জীবন গুছিয়ে আনুন। সুন্নাহগুলো অভ্যাসে আনুন। নামায বানান, নামায বানানোর জিনিস। এজন্য সময়ও দিতে হয় বৈকি, যা আটপৌরে জীবনে কখনোই হয়ে ওঠে না। ধ্যানময় যিকরের অভ্যাসের জন্য সময় দিতে হয়, তসবীহ টেপা শিখতে অবশ্য সময় দিতে হয় না৷ কুরআনের অভ্যাস সত্তাগত বানাতে আলাদা সময় দিতে হয়। সাথে আলিম থাকলে বিষয়ভিত্তিক ইলমও কিছু শেখা গেল। আর শিখতে হয় সরলতা। নিজেকে, অহমকে মিটানো, আরাম বিসর্জন দিয়ে কঠিন কাজ অপছন্দের কাজ নিজে করা। এরপর যে নামাযটা পড়বেন, শিশুর মত লুটিয়ে পড়া নামায হবে সেটা। সাহাবাদের রা. মত সরল সাদামাটা দাওয়াত: তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত। বারবার একই কথা বলে বলে অন্তরে খোদাই করে নেয়া আরকি। এগুলোর প্রতি সহজ সরল স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসমর্পণ। যান্ত্রিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সেই ঈমানের স্বাদ ফিরে পাওয়া চাই। নাবালেগ কীভাবে বুঝবে বালেগ হবার মজা।
গেলাম। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। সাহাবায়ে কিরাম রা. এর স্বতস্ফূর্ত ঈমান আমাদের মত পৈতৃক অন্ধবিশ্বাস ছিল না। তাদের বিশ্বাস দুটো মজবুত বুনিয়াদের উপর দাঁড়ানো ছিল। দুটো লজিকে হেরে তারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন নবীজীর দাওয়াতের সামনে। তাদের তাবৎ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান (emmpirical evidence) দুটো জিনিসের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল। আবু বাকর রা. যে আবু জাহলের মুখে মিরাজের ঘটনা শুনে বলেছিলেন: যদি মুহাম্মাদ সা. এই দাবি করে থাকেন, তাহলে তা সত্য। এই কথা নবীজীর প্রতি তাঁর অন্ধবিশ্বাস ছিল না। বরং এটা ছিল ৪০ বছরের চোখ-খোলা বিশ্বাস। আবু বাকর রা. এর ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা ওঠাবসা তাকে বলেছে, মুহাম্মাদ মিথ্যা বলতে পারেন না। একইভাবে মক্কার লোকেদেরকে আল্লাহ একটা বুনিয়াদে ঈমান আনতে বলেছেন, ঈমান চাপিয়ে দেননি। তোমাদের প্রতি 'তোমাদের মধ্য থেকে' একজন রাসূল, উম্মী রাসূল। আল্লাহ মক্কাবাসীকে আহ্বান করেছেন, তোমাদের ৪০ বছরের চর্মচক্ষুর জ্ঞানের উপর ইনসাফ করো। তোমরা খুব ভালো করেই জানো, এই ব্যক্তি ৪০ বছর কোনো মিথ্যা বলেনি, আল-আমীন নামে তোমরাই তাকে ডেকেছো। আবু সুফিয়ান হিরাক্লিয়াসের দরবারে পর্যন্ত মানসম্মানের ভয়ে বলতে বাধ্য হইসে: ইতিপূর্বে সে কখনও মিথ্যা বলেনি। মক্কাবাসী সাহাবীদের ঈমানের ভিত্তি নবীজীর ৪০ বছরের 'সীরাহ', এর বুনিয়াদেই আল্লাহ তাদের ঈমান আনতে বলেছেন, ভর্ৎসনা করেছেন। এটা গেল ১ নং।
আর ২ নং ছিল 'কুরআন'। আরবি ভাষা ও কাব্যে দক্ষতা। ১ ও ২ নং মিলিয়ে তাদের সামনে পুরো চ্যালেঞ্জটা ছিল: "এনাকে আমরা চিনি ভালোমতো, ইনি মিথ্যা বলতে পারেন না। আর এই কিতাব ইনার দ্বারা লেখাও সম্ভব না"। মদীনাওয়ালাদের ঈমান আনার পিছনে মূল ছিল ২ নং, সাথে মুহাজিরদের দেখাদেখি ১ নং গৌণ। কুরআনও সেই চ্যালেঞ্জই করেছে: যদি উম্মী হয়েও মুহাম্মদ লিখে থাকে, তবে তোমরা শিক্ষিৎ, তোমরা লিখে আনো একটা কিতাব, নইলে একটা সূরা, নইলে একটা আয়াতই আনো হে।
সীরাহ ও আরবি ভাষা শেখা ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম খুঁটি। ঈমানের মেহনত এই দুটো ছাড়া অপূর্ণ। কথা এতটুকুই। গেলাম৷

No comments:

ads
Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.